ঢাকা ০৭:৩০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

মুরাদনগর বাবুটিপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান চাকরি করেন ব্যাংকে, সচিব থাকেন বাড়িতে

সুমন সরকার, বিশেষ প্রতিনিধিঃ

জাকির হোসেন মুন্সি। তিনি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাবুটিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের দুই বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। এ জনপ্রতিনিধি চাকরি করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। বর্তমানে তিনি সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন ওই ব্যাংকের ঢাকার কাওরান বাজার শাখায়। এলাকার লোকজন তাকে শুক্রবারের দাওয়াতি চেয়ারম্যান হিসেবে জানেন। 

প্রতি শুক্রবার তিনি পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে এলাকায় আসেন দাওয়াত খেতে। আর সরকারি এবং পরিষদের কোনো কাজ লাগলে তার স্বাক্ষর আনতে যেতে হয় ঢাকার কাওরান বাজারে। একই কায়দায় এলাকার লোকজনের জন্ম-মৃত্যু এবং ওয়ারিশ সনদ, সার্টিফিকেট, ট্রেড লাইসেন্সসহ যেকোনো কাজে যেতে হয় ঢাকায়। 

গত ১০ বছর যাবত এমন অবস্থা বিরাজ করছে বাবুটিপাড়া ইউপিতে। এদিকে চেয়ারম্যান ঢাকায় চাকরি করেন আর পরিষদের সচিব থাকেন বাড়িতে। সোমবার সরেজমিনে দুপুর ১২টার দিকে ওই পরিষদে গিয়ে চেয়ারম্যান এবং সচিবের কক্ষে তালা ঝুলতে দেখা যায়। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার বিভাগের জনপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুসারে নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধি নিজ নির্বাচনী এলাকার জনসাধারণকে নিরলসভাবে সেবা প্রদান করবেন। যেকোনো ধরনের দুর্যোগ এবং দুর্ভোগে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নসহ দুর্গত জনসাধারণের পাশে থাকবেন। কিন্তু কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাবুটিপাড়া ইউপি থেকে দুই দুই বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান জাকির হোসেন মুন্সির ক্ষেত্রে চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। 

এ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে অফিস চলাকালীন সময়ে কখনো নিজ কার্যালয়ে বসেননি। আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হিসেবে তিনি দুই মেয়াদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ওই ইউপি চেয়ারম্যান সিনিয়র অফিসার হিসেবে চাকরি করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। সেই সুবাদে তিনি থাকেন ঢাকায়। গত ১০ বছর যাবত প্রয়োজনে তাকে কাছে পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ এলাকাবাসীদের। 

করোনা ভাইরাসের শুরুতে জাকির হোসেন মুন্সিকে এলাকায় না পেয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে শোকজও করা হয়। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে জনপ্রতিনিধিরা জনসাধারণের পাশে থেকে সেবা প্রদান করলেও শুক্রবার ছাড়া জাকির হোসেন মুন্সিকে এলাকায় দেখা যায়নি। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার বেশ কয়েকজন জানান, চেয়ারম্যান জাকির হোসেন প্রতি শুক্রবার এলাকায় আসেন দাওয়াত খেতে। এদিন শালিস দরবার কিংবা নিজ প্রয়োজনে নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তিনি। এলাকার মানুষ তাকে শুক্রবারের দাওয়াতি ও শালিসি চেয়ারম্যান হিসেবে চিনেন। আর মাঝখানে যেকোনো প্রয়োজনে চেয়ারম্যানের কাছে যেতে হয় ঢাকায়। 

এছাড়া এ চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরের অনেক মূল্য। কার্যালয়ে কর্মরতরা জরুরি প্রয়োজনে স্বাক্ষর আনতে ঢাকায় যেতে হয়। এ চেয়ারম্যান কার্যালয়ের উদ্যোক্তা এবং সচিবের বিরুদ্ধে রয়েছে সেবা প্রত্যাশীদেরকে জিম্মি করে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ। এদিকে চেয়ারম্যান ঢাকায় চাকরিতে ব্যস্ত থাকার সুযোগে পরিষদের সচিবও বেশীরভাগ সময় থাকেন বাড়িতে। যেকোনো প্রয়োজনে তাকেও খুঁজে পান না জনসাধারণ। সোমবার দুপুর ১২টার দিকে সরেজমিনে ওই কার্যালয়ে গিয়ে চেয়ারম্যান এবং সচিবের কক্ষে তালা ঝুলতে দেখা গেছে। 

এ সময় বেশ কিছু সেবা প্রত্যাশীকে সচিবের কক্ষের সামনে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। এ সময় অপেক্ষমাণ সেবা প্রত্যাশী নারী ওই ইউনিয়নের লাজইর গ্রামের মৃত. আব্দুল মবিনের স্ত্রী শেফালী বেগম বলেন, আমি একটা কাজে পরিষদে আসছি, চেয়ারম্যানের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে, তিনি সচিবের কাছে যেতে বলেছেন, কিন্তু সচিবের জন্য আমি এখানে অপেক্ষা করছি। 

একই ইউপির দড়ানীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সুরুজ মিয়া বলেন, পরিষদের সেবা সংক্রান্ত কাজে আমাদেরকে শুক্রবারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। কারণ শুক্রবার ছাড়া চেয়ারম্যান এলাকায় আসে না। গত ১০ বছর যাবত আমাদের ইউপিতে এমন অবস্থা বিরাজ করছে। 

বাবুটিপাড়া ইউপি সচিব আব্দুল হান্নান বলেন, কোনো সেবা প্রত্যাশীর কাছ থেকে আমরা অতিরিক্ত অর্থ আদায় করি না, আমি সব সময় পরিষদে থেকে আমার দায়িত্ব পালন করি।  

ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, আমি ব্যাংকে চাকরি করলেও এলাকার জনসাধারণের যেকোনো প্রয়োজনে দ্রুত ছুটে যাই। এলাকার মানুষ যেন আমার শূন্যতা অনুভব না করে সে বিষয়টি মাথায় রেখেই আমি চলাচল করি। এ পর্যন্ত কোনো সেবা প্রত্যাশী আমার পরিষদ থেকে সেবা বঞ্চিত হয়েছে এমন নজির নেই। শুক্রবার ছাড়াও আমি প্রায়ই এলাকায় যাই, পরিষদে বসে মানুষকে সেবা প্রদান করি।  

এ বিষয়ে মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অভিষেক দাশ বলেন, সচিব তার কর্ম দিবসে অফিসে থাকার কথা যেহেতু অফিসে ছিল না আমরা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব। নিয়মিত অফিস না করার কারণে চেয়ারম্যানকে এর আগেও একবার শোকজ করা হয়েছিল সে ও সময় এ বিষয়ে ক্ষমা চেয়েছিল। আমি চেয়ারম্যানের ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছি। প্রয়োজনে আবার তাকে শোকজ করা হবে।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

মুরাদনগর বাবুটিপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান চাকরি করেন ব্যাংকে, সচিব থাকেন বাড়িতে

আপডেট সময় ০৫:১৯:৪৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

সুমন সরকার, বিশেষ প্রতিনিধিঃ

জাকির হোসেন মুন্সি। তিনি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাবুটিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের দুই বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। এ জনপ্রতিনিধি চাকরি করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। বর্তমানে তিনি সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন ওই ব্যাংকের ঢাকার কাওরান বাজার শাখায়। এলাকার লোকজন তাকে শুক্রবারের দাওয়াতি চেয়ারম্যান হিসেবে জানেন। 

প্রতি শুক্রবার তিনি পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে এলাকায় আসেন দাওয়াত খেতে। আর সরকারি এবং পরিষদের কোনো কাজ লাগলে তার স্বাক্ষর আনতে যেতে হয় ঢাকার কাওরান বাজারে। একই কায়দায় এলাকার লোকজনের জন্ম-মৃত্যু এবং ওয়ারিশ সনদ, সার্টিফিকেট, ট্রেড লাইসেন্সসহ যেকোনো কাজে যেতে হয় ঢাকায়। 

গত ১০ বছর যাবত এমন অবস্থা বিরাজ করছে বাবুটিপাড়া ইউপিতে। এদিকে চেয়ারম্যান ঢাকায় চাকরি করেন আর পরিষদের সচিব থাকেন বাড়িতে। সোমবার সরেজমিনে দুপুর ১২টার দিকে ওই পরিষদে গিয়ে চেয়ারম্যান এবং সচিবের কক্ষে তালা ঝুলতে দেখা যায়। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার বিভাগের জনপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুসারে নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধি নিজ নির্বাচনী এলাকার জনসাধারণকে নিরলসভাবে সেবা প্রদান করবেন। যেকোনো ধরনের দুর্যোগ এবং দুর্ভোগে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নসহ দুর্গত জনসাধারণের পাশে থাকবেন। কিন্তু কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাবুটিপাড়া ইউপি থেকে দুই দুই বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান জাকির হোসেন মুন্সির ক্ষেত্রে চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। 

এ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে অফিস চলাকালীন সময়ে কখনো নিজ কার্যালয়ে বসেননি। আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হিসেবে তিনি দুই মেয়াদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ওই ইউপি চেয়ারম্যান সিনিয়র অফিসার হিসেবে চাকরি করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। সেই সুবাদে তিনি থাকেন ঢাকায়। গত ১০ বছর যাবত প্রয়োজনে তাকে কাছে পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ এলাকাবাসীদের। 

করোনা ভাইরাসের শুরুতে জাকির হোসেন মুন্সিকে এলাকায় না পেয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে শোকজও করা হয়। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে জনপ্রতিনিধিরা জনসাধারণের পাশে থেকে সেবা প্রদান করলেও শুক্রবার ছাড়া জাকির হোসেন মুন্সিকে এলাকায় দেখা যায়নি। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার বেশ কয়েকজন জানান, চেয়ারম্যান জাকির হোসেন প্রতি শুক্রবার এলাকায় আসেন দাওয়াত খেতে। এদিন শালিস দরবার কিংবা নিজ প্রয়োজনে নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তিনি। এলাকার মানুষ তাকে শুক্রবারের দাওয়াতি ও শালিসি চেয়ারম্যান হিসেবে চিনেন। আর মাঝখানে যেকোনো প্রয়োজনে চেয়ারম্যানের কাছে যেতে হয় ঢাকায়। 

এছাড়া এ চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরের অনেক মূল্য। কার্যালয়ে কর্মরতরা জরুরি প্রয়োজনে স্বাক্ষর আনতে ঢাকায় যেতে হয়। এ চেয়ারম্যান কার্যালয়ের উদ্যোক্তা এবং সচিবের বিরুদ্ধে রয়েছে সেবা প্রত্যাশীদেরকে জিম্মি করে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ। এদিকে চেয়ারম্যান ঢাকায় চাকরিতে ব্যস্ত থাকার সুযোগে পরিষদের সচিবও বেশীরভাগ সময় থাকেন বাড়িতে। যেকোনো প্রয়োজনে তাকেও খুঁজে পান না জনসাধারণ। সোমবার দুপুর ১২টার দিকে সরেজমিনে ওই কার্যালয়ে গিয়ে চেয়ারম্যান এবং সচিবের কক্ষে তালা ঝুলতে দেখা গেছে। 

এ সময় বেশ কিছু সেবা প্রত্যাশীকে সচিবের কক্ষের সামনে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। এ সময় অপেক্ষমাণ সেবা প্রত্যাশী নারী ওই ইউনিয়নের লাজইর গ্রামের মৃত. আব্দুল মবিনের স্ত্রী শেফালী বেগম বলেন, আমি একটা কাজে পরিষদে আসছি, চেয়ারম্যানের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে, তিনি সচিবের কাছে যেতে বলেছেন, কিন্তু সচিবের জন্য আমি এখানে অপেক্ষা করছি। 

একই ইউপির দড়ানীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সুরুজ মিয়া বলেন, পরিষদের সেবা সংক্রান্ত কাজে আমাদেরকে শুক্রবারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। কারণ শুক্রবার ছাড়া চেয়ারম্যান এলাকায় আসে না। গত ১০ বছর যাবত আমাদের ইউপিতে এমন অবস্থা বিরাজ করছে। 

বাবুটিপাড়া ইউপি সচিব আব্দুল হান্নান বলেন, কোনো সেবা প্রত্যাশীর কাছ থেকে আমরা অতিরিক্ত অর্থ আদায় করি না, আমি সব সময় পরিষদে থেকে আমার দায়িত্ব পালন করি।  

ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, আমি ব্যাংকে চাকরি করলেও এলাকার জনসাধারণের যেকোনো প্রয়োজনে দ্রুত ছুটে যাই। এলাকার মানুষ যেন আমার শূন্যতা অনুভব না করে সে বিষয়টি মাথায় রেখেই আমি চলাচল করি। এ পর্যন্ত কোনো সেবা প্রত্যাশী আমার পরিষদ থেকে সেবা বঞ্চিত হয়েছে এমন নজির নেই। শুক্রবার ছাড়াও আমি প্রায়ই এলাকায় যাই, পরিষদে বসে মানুষকে সেবা প্রদান করি।  

এ বিষয়ে মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অভিষেক দাশ বলেন, সচিব তার কর্ম দিবসে অফিসে থাকার কথা যেহেতু অফিসে ছিল না আমরা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব। নিয়মিত অফিস না করার কারণে চেয়ারম্যানকে এর আগেও একবার শোকজ করা হয়েছিল সে ও সময় এ বিষয়ে ক্ষমা চেয়েছিল। আমি চেয়ারম্যানের ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছি। প্রয়োজনে আবার তাকে শোকজ করা হবে।