ঢাকা ০৫:২৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

মৃত্যুকে অস্বীকার, মৃত প্রিয়জনের সঙ্গে বাস করাই তাদের রীতি!

অন্তর্জাতিক ডেস্ক:

মৃত্যু বলতে জীবনের সমাপ্তি বুঝায়। জীববিজ্ঞানের ভাষায় প্রাণ আছে এমন কোন জৈব পদার্থের (বা জীবের) জীবনের সমাপ্তিকে মৃত্যু বলে। মৃত্যুর পর প্রত্যেক ধর্মের রীতি অনুসারে মৃতর শেষ কাজ সম্পন্ন করা হয়। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মৃতের সঙ্গে বসবাস এমন কথা কখনো শুনেছেন! শুধু তাই নয় সেই মৃত ব্যক্তিকে নাকি রোজ স্নান করানো, পোশাক পরানো এমনকি খাওয়ানোও হয়! বিষয়টা অদ্ভুত ঠেকতে পারে অনেকের কাছে। অনেকের মনে হতেই পারে নেহাত বোকামি বা মানসিক ভারসাম্যহীনতার পরিচয়। কিন্তু যুগ যুগ ধরে তারা এই রীতিটাই মেনে আসছেন!

 

তাদের বিশ্বাস, মৃত্যু মানেই আত্মার দেহ ত্যাগ করা নয়। কারও মৃত্যু হওয়া মানে তিনি জীবিত কিন্তু ভীষণ অসুস্থ। তাই হাঁটাচলা, খাওয়া এমনকি কথা বলতে পারেন না।

মৃত্যুকে অস্বীকার, মৃত প্রিয়জনের সঙ্গে বাস করাই তাদের রীতি!

থোরাজা সম্প্রদায়ের কোনও আত্মীয়-পরিজনের মৃত্যু হলে তাই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বদলে তার বিশেষ যত্ন নিতে শুরু করেন তারা। কফিনের মধ্যে প্রিয়জনদের দেহ রেখে দেওয়া হয়। প্রতিদিন সময় করে জল, খাবার এমনকি সিগারেটও রোজ দেওয়া হয়। প্রতিদিন সময় করে পুরো দেহ পরিষ্কার করিয়ে, নতুন পোশাক বদলানো হয়। প্রিয়জনদের যাতে কখনো মনে না হয় তাদের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন না পরিবারের বাকি সদস্যেরা। খুব খেয়াল রাখা হয় এই বিষয়টাতে। প্রত্যেকেই তার সময়মতো কফিনের ঢাকনা খুলে প্রিয়জনের সঙ্গে গল্পও করেন। কফিনে শুয়ে থাকা প্রিয়জনের কাছ থেকে অবশ্য কোনও উত্তর মেলে না।

এইভাবে কোনও পরিবার এক সপ্তাহ, কোনও পরিবার একমাস আবার কেউ কেউ এক বছরও প্রিয়জনকে এভাবে নিজের কাছে রেখে দেন। যার সামর্থ্য যত বেশি, তিনি তত বেশি দিন নিজের কাছে ওই মৃতদেহ রেখে দেন। কারণ মৃতদেহ ভাল করে সংরক্ষণ করাটা জরুরি তা না হলে পচে-গলে যাবে। আর সেটা যথেষ্ট খরচ সাপেক্ষ। তার জন্য বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিকের প্রয়োজন হয়।

মৃত্যুকে অস্বীকার, মৃত প্রিয়জনের সঙ্গে বাস করাই তাদের রীতি!

এরপর আসে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পর্ব। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য হল, মহিষ বলি। থোরাজাদের বিশ্বাস, মৃত্যুর পর মহিষই তাদের স্বর্গের রাস্তা দেখিয়ে দেয়। মহিষের পিঠে চেপেই তারা স্বর্গলোকে যান। একজন মৃত ব্যক্তির জন্য অন্তত একটা মোষ বলি দেওয়াটা বাধ্যতামূলক। একটা মধ্যবিত্ত পরিবার একজনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য ২৪টা মহিষের বলি দেয়। সামর্থ্য থাকলে বলির সংখ্যা আরও বাড়ে।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার এই প্রক্রিয়াকে থোরাজারা বলেন রাম্বু সোলো। তাদের কাছে প্রথম বলি দেওয়া মোষ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার অর্থ হল, প্রিয়জনেরও মৃত্যু। আর তারপর যত বেশি সংখ্যক মহিষের বলি দেওয়া হবে, তত তাড়াতাড়ি আত্মা স্বর্গে পৌঁছতে পারবে। গরীব পরিবার, যাদের অনেক মোষ কেনার সামর্থ্য নেই, তারা একটি মহিষেরই বলি দেয়। থোরাজাদের বিশ্বাস অনুসারে এর অর্থ, সে ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির মৃত্যু নিশ্চিত করল ওই একটি মোষের বলি কিন্তু তার আত্মা স্বর্গে না পৌঁছতেও পারে।

মৃত্যুকে অস্বীকার, মৃত প্রিয়জনের সঙ্গে বাস করাই তাদের রীতি!

থোরাজারা যে দীর্ঘ সময় মৃতদেহ বাড়িতে রেখে দেন। অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে তার পিছনে অন্য একটি কারণও রয়েছে। তাদের বিশ্বাস, থোরাজারা অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া খুব ঘটা করে পালন করেন। তা নাহলে আত্মার স্বর্গ যাত্রা হবে না। আর এর জন্য মহিষের প্রয়োজন। মহিষ কেনার টাকা এবং অন্ত্যেষ্টিরীতির আনুষঙ্গিক খরচ জমানোর জন্যই তারা এতদিন মৃতদেহ বাড়িতে রাখেন। বলি দেওয়ার পর মহিষের মাংস উপস্থিত আত্মীয় পরিজনদের খাওয়ানো হয়।

মৃতদেহ কবর দেয় না থোরাজারা। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর মৃতদেহ সমেত কফিন নির্দিষ্ট কোনও গুহায় রেখে দেওয়া হয়। পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় এমন গুহা প্রচুর রয়েছে পাঙ্গালায়।

কিন্তু তার পরও প্রিয়জনকে ‘ভুলে’ যান না তারা। বছরে একবার সমস্ত আত্মীয়-পরিজন সেই গুহার কাছে জড়ো হন, কফিন থেকে মৃতদেহ তুলে পরিষ্কার করে নতুন পোশাক পরানো হয়, খাওয়ানো হয়। এভাবেই তাদের সম্মান জানানোর রীতি চলতে থাকে।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

মৃত্যুকে অস্বীকার, মৃত প্রিয়জনের সঙ্গে বাস করাই তাদের রীতি!

আপডেট সময় ০১:০১:৫৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ জুলাই ২০১৯
অন্তর্জাতিক ডেস্ক:

মৃত্যু বলতে জীবনের সমাপ্তি বুঝায়। জীববিজ্ঞানের ভাষায় প্রাণ আছে এমন কোন জৈব পদার্থের (বা জীবের) জীবনের সমাপ্তিকে মৃত্যু বলে। মৃত্যুর পর প্রত্যেক ধর্মের রীতি অনুসারে মৃতর শেষ কাজ সম্পন্ন করা হয়। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মৃতের সঙ্গে বসবাস এমন কথা কখনো শুনেছেন! শুধু তাই নয় সেই মৃত ব্যক্তিকে নাকি রোজ স্নান করানো, পোশাক পরানো এমনকি খাওয়ানোও হয়! বিষয়টা অদ্ভুত ঠেকতে পারে অনেকের কাছে। অনেকের মনে হতেই পারে নেহাত বোকামি বা মানসিক ভারসাম্যহীনতার পরিচয়। কিন্তু যুগ যুগ ধরে তারা এই রীতিটাই মেনে আসছেন!

 

তাদের বিশ্বাস, মৃত্যু মানেই আত্মার দেহ ত্যাগ করা নয়। কারও মৃত্যু হওয়া মানে তিনি জীবিত কিন্তু ভীষণ অসুস্থ। তাই হাঁটাচলা, খাওয়া এমনকি কথা বলতে পারেন না।

মৃত্যুকে অস্বীকার, মৃত প্রিয়জনের সঙ্গে বাস করাই তাদের রীতি!

থোরাজা সম্প্রদায়ের কোনও আত্মীয়-পরিজনের মৃত্যু হলে তাই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বদলে তার বিশেষ যত্ন নিতে শুরু করেন তারা। কফিনের মধ্যে প্রিয়জনদের দেহ রেখে দেওয়া হয়। প্রতিদিন সময় করে জল, খাবার এমনকি সিগারেটও রোজ দেওয়া হয়। প্রতিদিন সময় করে পুরো দেহ পরিষ্কার করিয়ে, নতুন পোশাক বদলানো হয়। প্রিয়জনদের যাতে কখনো মনে না হয় তাদের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন না পরিবারের বাকি সদস্যেরা। খুব খেয়াল রাখা হয় এই বিষয়টাতে। প্রত্যেকেই তার সময়মতো কফিনের ঢাকনা খুলে প্রিয়জনের সঙ্গে গল্পও করেন। কফিনে শুয়ে থাকা প্রিয়জনের কাছ থেকে অবশ্য কোনও উত্তর মেলে না।

এইভাবে কোনও পরিবার এক সপ্তাহ, কোনও পরিবার একমাস আবার কেউ কেউ এক বছরও প্রিয়জনকে এভাবে নিজের কাছে রেখে দেন। যার সামর্থ্য যত বেশি, তিনি তত বেশি দিন নিজের কাছে ওই মৃতদেহ রেখে দেন। কারণ মৃতদেহ ভাল করে সংরক্ষণ করাটা জরুরি তা না হলে পচে-গলে যাবে। আর সেটা যথেষ্ট খরচ সাপেক্ষ। তার জন্য বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিকের প্রয়োজন হয়।

মৃত্যুকে অস্বীকার, মৃত প্রিয়জনের সঙ্গে বাস করাই তাদের রীতি!

এরপর আসে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পর্ব। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য হল, মহিষ বলি। থোরাজাদের বিশ্বাস, মৃত্যুর পর মহিষই তাদের স্বর্গের রাস্তা দেখিয়ে দেয়। মহিষের পিঠে চেপেই তারা স্বর্গলোকে যান। একজন মৃত ব্যক্তির জন্য অন্তত একটা মোষ বলি দেওয়াটা বাধ্যতামূলক। একটা মধ্যবিত্ত পরিবার একজনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য ২৪টা মহিষের বলি দেয়। সামর্থ্য থাকলে বলির সংখ্যা আরও বাড়ে।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার এই প্রক্রিয়াকে থোরাজারা বলেন রাম্বু সোলো। তাদের কাছে প্রথম বলি দেওয়া মোষ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার অর্থ হল, প্রিয়জনেরও মৃত্যু। আর তারপর যত বেশি সংখ্যক মহিষের বলি দেওয়া হবে, তত তাড়াতাড়ি আত্মা স্বর্গে পৌঁছতে পারবে। গরীব পরিবার, যাদের অনেক মোষ কেনার সামর্থ্য নেই, তারা একটি মহিষেরই বলি দেয়। থোরাজাদের বিশ্বাস অনুসারে এর অর্থ, সে ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির মৃত্যু নিশ্চিত করল ওই একটি মোষের বলি কিন্তু তার আত্মা স্বর্গে না পৌঁছতেও পারে।

মৃত্যুকে অস্বীকার, মৃত প্রিয়জনের সঙ্গে বাস করাই তাদের রীতি!

থোরাজারা যে দীর্ঘ সময় মৃতদেহ বাড়িতে রেখে দেন। অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে তার পিছনে অন্য একটি কারণও রয়েছে। তাদের বিশ্বাস, থোরাজারা অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া খুব ঘটা করে পালন করেন। তা নাহলে আত্মার স্বর্গ যাত্রা হবে না। আর এর জন্য মহিষের প্রয়োজন। মহিষ কেনার টাকা এবং অন্ত্যেষ্টিরীতির আনুষঙ্গিক খরচ জমানোর জন্যই তারা এতদিন মৃতদেহ বাড়িতে রাখেন। বলি দেওয়ার পর মহিষের মাংস উপস্থিত আত্মীয় পরিজনদের খাওয়ানো হয়।

মৃতদেহ কবর দেয় না থোরাজারা। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর মৃতদেহ সমেত কফিন নির্দিষ্ট কোনও গুহায় রেখে দেওয়া হয়। পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় এমন গুহা প্রচুর রয়েছে পাঙ্গালায়।

কিন্তু তার পরও প্রিয়জনকে ‘ভুলে’ যান না তারা। বছরে একবার সমস্ত আত্মীয়-পরিজন সেই গুহার কাছে জড়ো হন, কফিন থেকে মৃতদেহ তুলে পরিষ্কার করে নতুন পোশাক পরানো হয়, খাওয়ানো হয়। এভাবেই তাদের সম্মান জানানোর রীতি চলতে থাকে।