স্টাফ রিপোর্টার : বিচার বিভাগের ‘কোন্দল’ প্রকাশ্যে এনে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে দায়ী করে তাকে কথা ‘কম’ বলার পরামর্শ দিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
অবসরে যাওয়ার পর বিচারকদের রায় লেখা ‘সংবিধান পরিপন্থি’ বলে বক্তব্য দিয়ে প্রধান বিচারপতি অনধিকার চর্চা করেছেন বলেও মনে করছেন বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের অন্যতম এই প্রণেতা।
সোমবার রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে এক আলোচনা সভায় বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার বছর পূর্তিতে বিচারপতি এস কে সিনহার বাণীর প্রসঙ্গটি তোলেন সুরঞ্জিত।
গত ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির ওই বক্তব্য আসার পর থেকে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা চলছে। তার ভিত্তিতে বিএনপি বলছে, অবসরের পরে লেখা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের রায়ও তাহলে অবৈধ।
সুরঞ্জিত বলেন, “সাংবিধানিকভাবে তিনি (প্রধান বিচারপতি) দেশের প্রধান তিনজনের একজন। প্রধান বিচারপতিরা প্রধান বিচার করেন, প্রধান প্রধান কথা বলেন না। এই পদে থেকে সাধারণত প্রধান কথা শোনা যায় না।
“এই পদে থেকে তিনি এমন কিছু কথা বলে ফেলেছেন, যা জাতীয় রাজনীতিতে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এভাবে কথা বলতে বলতে তিনি কোথায় চলে যাচ্ছেন, তার সীমানা থাকছে না।”
বিচারপতি সিনহার বক্তব্যে সংবিধানের সমর্থন নেই বলে দাবি করেন বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য এবং পঞ্চদশ সংশোধনী সংক্রান্ত সংসদীয় বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত।
“তিনি এমন কিছু কথা বলেছেন, যা সংবিধানের কোথাও নেই। সংবিধান রচনা করেছি আমি। সংবিধানের কোন জায়গায় লেখা আছে যে বিচারপতিরা অবসরে গেলে রায় লেখা যাবে না? এ কথা সংবিধানের কোথাও লেখা নেই।”
“উনি যা বলেছেন, এটা তো কোনো আইন নয়। উনি যদি মনে করেন, শপথ শেষ হয়ে গেলে আর বিচার দেখতে দেব না, সেটা অবসরে যাওয়ার কতদিন আগ থেকে, জাজমেন্ট ঘোষণা করতে হবে? এটাও আইনে আনতে হবে।”
প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের অন্তঃকোন্দল প্রকাশ্য হয়েছে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এই সদস্য।
“আপনারা দুই বিচারপতির মধ্যে গোলমাল, আক্রোশ-বিক্রোশ, এটা বাইরে আসবে কেন? আমি এবং তুমি- এটা জনগণ জানবে কেন? আপনাদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে, আর আপনি সেটা নিয়ে পাবলিকলি কথা বলে অনেককে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছেন। নিজস্ব কোন্দলের জন্য জাতীয়ভাবে এত বড় একটা উত্তেজনা সৃষ্টি করবেন, এটা আমরা আশা করি না।”
এর মধ্য দিয়ে স্পষ্টতই সম্প্রতি অবসরে যাওয়া সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর অভিযোগের দিকে ইঙ্গিত করেছেন সুরঞ্জিত গুপ্ত।
আপিল বিভাগ থেকে কয়েক মাস আগে অবসরে যাওয়া বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী অভিযোগ করেছিলেন, রায় লেখা শেষ না করায় তার পেনশন আটকে দিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে প্রধান বিচারপতির সাম্প্রতিক আরেক বক্তব্যেরও প্রতিবাদ জানান ক্ষমতাসীন দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা
“আপনাকে প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দেওয়ার পর রাগ-অভিমান-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে দেশের জন্য, জাতির জন্য কাজ করে যাওয়ার কথা। আর আপনি বলে উঠলেন, আপনার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে!
“আইনের শাসনের যুগ, আপনারা তো স্বাধীন আলাদা। সংবিধানে স্পষ্ট লেখা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি এই তিনটি অঙ্গনই একে অপরের পরিপূরক।”
বৃহত্তর সিলেটের বাসিন্দা বিচারপতি সিনহাকে বাক সংযমী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে একই অঞ্চলের সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত বলেন, “আপনি কথাবার্তা আরও সংযত হয়ে বলুন। এমন কোনো কথা বলবেন না, যা জাতীয় জীবনে-রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে, সংঘাতপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
“যত কথা কম বলা যায়। একেবারে বাক সংযত। আপনার এখনও সময় আছে। প্রতিষ্ঠানটির কথা চিন্তা করুন।”
আইন মেনে চলতে খালেদাকে পরামর্শ
বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের এই আলোচনা সভায় সুরঞ্জিত মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্যের প্রসঙ্গটিও তোলেন।
ওই বক্তব্য নিয়ে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সোমবারই রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা আমলে নিয়েছে আদালত, তাকে আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতেও বলা হয়েছে।
সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত বলেন, “খালেদার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে। তার মানে এই নয় যে আজ মামলা হয়েছে, কাল উনাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসবে।
“দেশে কোনো সামরিক শাসন চলছে না। উনি আদালতে আত্মসমর্পণ করতে পারেন। আবারও জামিনের আবেদনও জানাতে পারেন।”
কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয় মন্তব্য করে সুরঞ্জিত বলেন, “আমরা দেশের এক-দু’নম্বর নেতা হলেই যা ইচ্ছা তাই করতে চাই। আমি তাকে (খালেদা) বলব, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন।”
ঢাকার আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজের স্মরণে এই আলোচনা সভায় সুরঞ্জিত ছাড়াও বক্তব্য রাখেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অরুণ সরকার রানা প্রমুখ।