ঢাকা ০২:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাঞ্ছারামপুরে এখন উপকরনের নামে নেওয়া হচ্ছে যৌতুক

ফয়সল আহমেদ খান, বাঞ্ছারামপুর (বি-বাড়িয়া) প্রতিনিধিঃ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় এখন সরাসরি যৌতুক না নিয়ে কনে পক্ষের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে খুশীর উপহার। এমন অভিযোগ করেছেন বহু কন্যাদায় গ্রস্থ পিতা।বিয়েতে বাধ্যতামূলক লক্ষ লক্ষ টাকার ‘উপহার নামক যৌতুক’ দেয়াটা যেন রীতিতে পরিনত হতে চলেছে।

এতে চাপ বাড়ছে কন্যা পরিবারদের উপর। বাড়ছে সামাজিক ও পারিবারিক অশান্তি।উপহারের জন্য বাড়ছে নারী নির্যাতন।দেশে প্রতি বছর গড়ে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সাশিল কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখাননুযায়ী ২ শতাধিক নারীকে হত্যার স্বীকার হতে হয়।আর আত্বহত্যা করেন সমপরিমান নারী।

আর যৌতুকের প্রকারান্তে উপহার না পেয়ে স্বামী/শশুড়বাড়ি কর্তৃক মানসিক, শারীরিক নির্যাতন কতোটা বৃদ্ধি পেয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও কেবল বাঞ্ছারামপুর উপজেলাতেই এমন নির্যাতনের ঘটনা প্রতি মাসে ৫০টির মতো ঘটে বলে অভিজ্ঞরা মনে করছেন।

খোজ নিয়ে জানা গেছে,বিয়ের কথাবার্তা পাকা করার সময়ই পাত্রপক্ষরা আগের মতো নগদ টাকা দাবী না করে পাত্রকে খুশী হয়ে যা উপহার দিবেন,তা-ই যেন দেয়া হয় এমন প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিচ্ছেন।

ভিন্নদিকে,কনে পক্ষকে জোরপূর্বক অনেকটা বাধ্য হয়ে মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ‘খুশী’ হতে হচ্ছে বলে জানা গেছে।

বাঞ্ছারামপুর সদর ইউনিয়নের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কন্যা দায়গ্রস্থ কয়েকজন নিম্নমধ্যবিত্ত পিতা জানান,-‘আগেই ভালো ছিলো,৩/৪ লাখ টাকা নগদ ধরিয়ে দিতাম,সমস্যা চুকে গেলো।আর এখন আমাদের বাধ্যতামূলক খুশী হয়ে পাত্র পক্ষকে ঘরের যাবতীয় ফার্নিচার,টিভি,ফ্রীজ,মোটর সাইকেল কিনতে যেয়ে ৮/১০ লাখ টাকা চলে যাচ্ছে’।

উপজেলার দূর্গাপুর গ্রামের দরিদ্র কৃষক রশিদ মিয়া আঞ্চলিক ভাষায় জানান, মেয়ের বিয়ে ঠিকঠাক করছি।পাত্র থাহে সৌদি আরব।ওরা জানাইছিলো পাত্র মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতন পায়।কোন যৌতুক লাগবো না।কিন্তু,বিয়ার আগের দিন ছেলের মামা আইয়া কয়,-‘আপনি পাত্রকে কিন্তু খুশী হইয়া ঘর সাজাইবার জিনিসপত্র দিবেন।আপনি চিন্না-বুইঝ্যা কিনতে না পারলে ফার্নিচারের দাম বাবদ ৫ লাখ দিয়েন,হেরা কিন্ন্যা লইবো।’ আমি চোখে মুখে আন্ধা দেখলাম।বিয়া ভাইংগ্যা গেলো।’

এ বিষয়ে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.শরিফুল ইসলাম বলেন,-‘যৌতুকের কারণে নির্যাতন ও হত্যার মতো অপরাধের দায় শুধু শ্বশুরবাড়ির লোকদের নয়। মেয়ের বাবা-মা থেকে সমাজ পর্যন্ত সে দায় কেউ এড়াতে পারে না। কারণ যৌতুকের বিয়ে কেবল এক পক্ষের ইচ্ছায় হয় না। এতে উভয় পক্ষের উৎসাহ এবং সমাজের চাপ থাকে।ফার্নিচার দেয়াটাও যৌতুক।যৌতুক দেয়া-নেয়া উভয়ই দন্ডনীয় অপরাধ।’

এ বিষয়ে শিক্ষীকা ও লেখক-সাংবাদিক সালমা আহমেদ বলেন,-‘বিয়ের পর মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি যায়। আর ছেলেটি বিয়ে করে বউ বাড়ি নিয়ে আসে। ছেলেটি ‘ক্ষমতাধর’ এবং মেয়েটি ‘পুরুষ’ ও ‘ক্ষমতার’ কাছে বিনয়ে সমর্পিত একটি ‘সত্তা’। এই ‘সত্তা’র নাম ‘মেয়েমানুষ’।

সমাজে সবকিছু নেয়ার অধিকার পুরুষদের এবং দেয়ার দায়িত্ব মেয়ে মানুষদের। কিন্তু মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার সময় কেবল নিজের সত্তাটা সঙ্গে নিয়ে গেলেই হয় না। শ্বশুরবাড়িতে বাবা নামক পুরুষটির ক্ষমতার দাপট দেখাতে সঙ্গে নিতে হয় আনুষঙ্গিক বিষয়াদি। সেটি ভাতের হাঁড়ি থেকে শুরু করে ঘুমানোর খাট পর্যন্ত। যেন ছেলেটি বিয়ের পরে খাটে ঘুমাতে বাধ্য, এবং সেজন্য তাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে খাট নিতেই হবে। বিয়েতে বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে খাট না আনলে মাটিতে ঘুমাতে দেয়ার নজির কম নেই।’’

বাঞ্ছারামপুর উপজেলা মহিলা বিষয়ক জনৈকা কর্মকর্তা বলেন,-‘আমার এক নিকট আত্মীয়ের বাপের বাড়ি থেকে প্রায় কিছুই না দিয়ে বিয়ে হয়েছিল। এমনকি তাকে লেপ-তোষক পর্যন্ত দেয়া হয়নি। এজন্য জানুয়ারির শীতে বাসর রাতে নববধূকে ঘুমানোর জন্য কোনো বিছানাই দেয়নি শ্বশুরবাড়ির লোকজন।’’

‘‘কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ছেলে নিজে থেকে যা চায়, বা চাপ সৃষ্টি করে কেবল তাই যৌতুক? মেয়ের বিয়েতে সামাজিকতা বজায় রাখতে সব কিছু দিয়ে দেয়া হলেও তাকে বলি উপহার। এতে করে কি যৌতুক সামাজিক মর্যাদা পায় না? উত্তর অবশ্যই হ্যাঁ এবং এতে এর গতিশীলতা বাড়ে। বাড়ে নির্যাতনের মাত্রা।এ বিষয়ে নাগরিক সচেতনা বৃদ্ধি করনে সরকারি উদ্যোগে সভা-সমাবেশে উপহার/যৌতুককে না বলতে হবে’’-বলে মন্তব্য করেন বাঞ্ছারামপুরস্থ ইউনিসেফের ফোকাল পার্সন সাংবাদিক ফয়সল আহমেদ খান।

তিনি ্আরো বলেন,-‘যৌতুকের কারণে আমাদের দেশে নারী নির্যাতন, হত্যা, আত্মহত্যা, এসিড নিক্ষেপের ঘটনা অহরহই ঘটে। আর সমাজের সচেতন মানুষ যখন যৌতুকের পরিবর্তে আকাংক্ষার অতিরিক্ত উপহারের ডালা সাজিয়ে দেন, তখন যৌতুক পিয়াসীদের সুযোগ আরো বেড়ে যায়। তবে দোষটা যে কেবল যৌতুক পিয়াসীদের নয়, উপহার বিলাসীদেরও সেটি মনে রাখা দরকার।’

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

শিক্ষার্থীদের উপর হামলার প্রতিবাদে মুরাদনগরে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ

বাঞ্ছারামপুরে এখন উপকরনের নামে নেওয়া হচ্ছে যৌতুক

আপডেট সময় ০২:০১:৪৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ এপ্রিল ২০১৮
ফয়সল আহমেদ খান, বাঞ্ছারামপুর (বি-বাড়িয়া) প্রতিনিধিঃ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় এখন সরাসরি যৌতুক না নিয়ে কনে পক্ষের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে খুশীর উপহার। এমন অভিযোগ করেছেন বহু কন্যাদায় গ্রস্থ পিতা।বিয়েতে বাধ্যতামূলক লক্ষ লক্ষ টাকার ‘উপহার নামক যৌতুক’ দেয়াটা যেন রীতিতে পরিনত হতে চলেছে।

এতে চাপ বাড়ছে কন্যা পরিবারদের উপর। বাড়ছে সামাজিক ও পারিবারিক অশান্তি।উপহারের জন্য বাড়ছে নারী নির্যাতন।দেশে প্রতি বছর গড়ে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সাশিল কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখাননুযায়ী ২ শতাধিক নারীকে হত্যার স্বীকার হতে হয়।আর আত্বহত্যা করেন সমপরিমান নারী।

আর যৌতুকের প্রকারান্তে উপহার না পেয়ে স্বামী/শশুড়বাড়ি কর্তৃক মানসিক, শারীরিক নির্যাতন কতোটা বৃদ্ধি পেয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও কেবল বাঞ্ছারামপুর উপজেলাতেই এমন নির্যাতনের ঘটনা প্রতি মাসে ৫০টির মতো ঘটে বলে অভিজ্ঞরা মনে করছেন।

খোজ নিয়ে জানা গেছে,বিয়ের কথাবার্তা পাকা করার সময়ই পাত্রপক্ষরা আগের মতো নগদ টাকা দাবী না করে পাত্রকে খুশী হয়ে যা উপহার দিবেন,তা-ই যেন দেয়া হয় এমন প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিচ্ছেন।

ভিন্নদিকে,কনে পক্ষকে জোরপূর্বক অনেকটা বাধ্য হয়ে মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ‘খুশী’ হতে হচ্ছে বলে জানা গেছে।

বাঞ্ছারামপুর সদর ইউনিয়নের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কন্যা দায়গ্রস্থ কয়েকজন নিম্নমধ্যবিত্ত পিতা জানান,-‘আগেই ভালো ছিলো,৩/৪ লাখ টাকা নগদ ধরিয়ে দিতাম,সমস্যা চুকে গেলো।আর এখন আমাদের বাধ্যতামূলক খুশী হয়ে পাত্র পক্ষকে ঘরের যাবতীয় ফার্নিচার,টিভি,ফ্রীজ,মোটর সাইকেল কিনতে যেয়ে ৮/১০ লাখ টাকা চলে যাচ্ছে’।

উপজেলার দূর্গাপুর গ্রামের দরিদ্র কৃষক রশিদ মিয়া আঞ্চলিক ভাষায় জানান, মেয়ের বিয়ে ঠিকঠাক করছি।পাত্র থাহে সৌদি আরব।ওরা জানাইছিলো পাত্র মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতন পায়।কোন যৌতুক লাগবো না।কিন্তু,বিয়ার আগের দিন ছেলের মামা আইয়া কয়,-‘আপনি পাত্রকে কিন্তু খুশী হইয়া ঘর সাজাইবার জিনিসপত্র দিবেন।আপনি চিন্না-বুইঝ্যা কিনতে না পারলে ফার্নিচারের দাম বাবদ ৫ লাখ দিয়েন,হেরা কিন্ন্যা লইবো।’ আমি চোখে মুখে আন্ধা দেখলাম।বিয়া ভাইংগ্যা গেলো।’

এ বিষয়ে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.শরিফুল ইসলাম বলেন,-‘যৌতুকের কারণে নির্যাতন ও হত্যার মতো অপরাধের দায় শুধু শ্বশুরবাড়ির লোকদের নয়। মেয়ের বাবা-মা থেকে সমাজ পর্যন্ত সে দায় কেউ এড়াতে পারে না। কারণ যৌতুকের বিয়ে কেবল এক পক্ষের ইচ্ছায় হয় না। এতে উভয় পক্ষের উৎসাহ এবং সমাজের চাপ থাকে।ফার্নিচার দেয়াটাও যৌতুক।যৌতুক দেয়া-নেয়া উভয়ই দন্ডনীয় অপরাধ।’

এ বিষয়ে শিক্ষীকা ও লেখক-সাংবাদিক সালমা আহমেদ বলেন,-‘বিয়ের পর মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি যায়। আর ছেলেটি বিয়ে করে বউ বাড়ি নিয়ে আসে। ছেলেটি ‘ক্ষমতাধর’ এবং মেয়েটি ‘পুরুষ’ ও ‘ক্ষমতার’ কাছে বিনয়ে সমর্পিত একটি ‘সত্তা’। এই ‘সত্তা’র নাম ‘মেয়েমানুষ’।

সমাজে সবকিছু নেয়ার অধিকার পুরুষদের এবং দেয়ার দায়িত্ব মেয়ে মানুষদের। কিন্তু মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার সময় কেবল নিজের সত্তাটা সঙ্গে নিয়ে গেলেই হয় না। শ্বশুরবাড়িতে বাবা নামক পুরুষটির ক্ষমতার দাপট দেখাতে সঙ্গে নিতে হয় আনুষঙ্গিক বিষয়াদি। সেটি ভাতের হাঁড়ি থেকে শুরু করে ঘুমানোর খাট পর্যন্ত। যেন ছেলেটি বিয়ের পরে খাটে ঘুমাতে বাধ্য, এবং সেজন্য তাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে খাট নিতেই হবে। বিয়েতে বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে খাট না আনলে মাটিতে ঘুমাতে দেয়ার নজির কম নেই।’’

বাঞ্ছারামপুর উপজেলা মহিলা বিষয়ক জনৈকা কর্মকর্তা বলেন,-‘আমার এক নিকট আত্মীয়ের বাপের বাড়ি থেকে প্রায় কিছুই না দিয়ে বিয়ে হয়েছিল। এমনকি তাকে লেপ-তোষক পর্যন্ত দেয়া হয়নি। এজন্য জানুয়ারির শীতে বাসর রাতে নববধূকে ঘুমানোর জন্য কোনো বিছানাই দেয়নি শ্বশুরবাড়ির লোকজন।’’

‘‘কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ছেলে নিজে থেকে যা চায়, বা চাপ সৃষ্টি করে কেবল তাই যৌতুক? মেয়ের বিয়েতে সামাজিকতা বজায় রাখতে সব কিছু দিয়ে দেয়া হলেও তাকে বলি উপহার। এতে করে কি যৌতুক সামাজিক মর্যাদা পায় না? উত্তর অবশ্যই হ্যাঁ এবং এতে এর গতিশীলতা বাড়ে। বাড়ে নির্যাতনের মাত্রা।এ বিষয়ে নাগরিক সচেতনা বৃদ্ধি করনে সরকারি উদ্যোগে সভা-সমাবেশে উপহার/যৌতুককে না বলতে হবে’’-বলে মন্তব্য করেন বাঞ্ছারামপুরস্থ ইউনিসেফের ফোকাল পার্সন সাংবাদিক ফয়সল আহমেদ খান।

তিনি ্আরো বলেন,-‘যৌতুকের কারণে আমাদের দেশে নারী নির্যাতন, হত্যা, আত্মহত্যা, এসিড নিক্ষেপের ঘটনা অহরহই ঘটে। আর সমাজের সচেতন মানুষ যখন যৌতুকের পরিবর্তে আকাংক্ষার অতিরিক্ত উপহারের ডালা সাজিয়ে দেন, তখন যৌতুক পিয়াসীদের সুযোগ আরো বেড়ে যায়। তবে দোষটা যে কেবল যৌতুক পিয়াসীদের নয়, উপহার বিলাসীদেরও সেটি মনে রাখা দরকার।’