জাতীয় ডেস্কঃ
মেয়াদ শেষে ভোটের আগেই পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের কাজ শেষ করতে চায় সরকার। আর এটা সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে দুটি পিয়ারের ওপর একটি স্প্যান বসিয়ে সেতুর অবকাঠামো দৃশ্যমান করা হলেও নির্ধারিত সময় ২০১৮ সালের নভেম্বরের মধ্যে মূল সেতুর কাজ শেষ হবে কি না-তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সেতুর কাজ শেষ হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান জামিলুর রেজা চৌধুরী বলছেন, কাজ শেষ হতে আরো কয়েক মাস লাগবে। তার ভাষ্য-সেতুর কাজ পুরোদমে চলছে। ভূমি কাঠামোর কারণে ১৪টি ‘পিলার’ বসানো নিয়ে নকশায় পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম।
তবে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলছেন, আগামী বছরের মধ্যেই পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হবে বলে আমরা আশা করছি এবং এটা হবে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, নভেম্বর পর্যন্ত ২৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৪৯ শতাংশ। এর মধ্যে মূল সেতুর কাজ ৫২ শতাংশ এবং নদী শাসনের কাজ শেষ হয়েছে ৩৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। এর বাইরে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়ার কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণের জন্য মোট ৪২টি পিয়ারের ওপর ৪১টি স্প্যান বসবে। এর মধ্যে নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র দুটি পিয়ারের ওপর স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৪০টি পিয়ার ও সেগুলোর ওপর স্প্যান বসানোর কাজ এগিয়ে চলেছে।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিয়ারের ওপর ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে প্রথম স্প্যানটি বসিয়ে সেতুর অবকাঠামো দৃশ্যমান করা হয়, যেটাকে ২০১৭ সালে পদ্মা সেতুর কাজে অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।মূল কাজ শুরুর পৌনে দুই বছর পর জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যানটি বসানো হয়। সেতুর অন্যান্য পিয়ারের কাজ এগিয়ে চললেও গভীরতার কারণে নদীর মধ্যের ১৪টি পিয়ার বসানোর কাজ নিয়ে নকশা পরিবর্তনের প্রয়োজন হওয়ায় এবং ‘টেস্ট পাইলিং’ শুরু করতে দেরি হওয়ায় নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, পদ্মা সেতুর পিয়ার বসানোর জন্য ২৪০টি পাইলের মধ্যে ৮০টি পাইলের টপ সেকশনের কাজ শেষ হয়েছে। এদিকে পদ্মা সেতুর মূল কাজের পাশাপাশি নদী শাসনের কাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। প্রয়োজনীয় এক কোটি ৩৩ লাখ কংক্রিট ব্লকের মধ্যে প্রায় ৩৫ লাখ ব্লক তৈরি হয়েছে। নদী শাসনের কাজ ৩৪ ভাগের বেশি শেষ হলেও এই সময়ে কাজের অগ্রগতি থাকার কথা ছিল প্রায় ৫৬ শতাংশ।
সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে ২০ নভেম্বর একটি প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে, যাতে প্রকল্প কাজ আট মাস পিছিয়ে থাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। ফলে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এই সেতুর কাজ শেষ করা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে কাজে গতি আনতে কিছু সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪২টি পিয়ারের মধ্যে ১৪টির ‘পাইল ডিজাইন’ সংশোধনের আওতায় রয়েছে। এগুলো কবে পাওয়া যাবে সে বিষয়ে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টা জানতে চাওয়া হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোনো কোনো পিয়ার ১২৮ মিটার পর্যন্ত গভীরে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে মাটির অবস্থা বিবেচনায় তা করা যাচ্ছে না। এ জন্য নদীর মাঝের ওই ১৪টি পিয়ারের জায়গায় পিয়ার সংখ্যা আরো বাড়িয়ে নতুন নকশা তৈরির কাজ চলছে। দ্রুতই এ কাজ শেষ করা হবে বলে জানান জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি বলেন, ওই পিয়ারগুলোর পাইলিংয়ের কাজ আগামী মে মাসের মধ্যেই শেষ করতে হবে। তা না হলে বর্ষায় পানির তোড় বেড়ে যাওয়ায় ওই জায়গায় পাইলিংয়ে সমস্যা হতে পারে।
মূল সেতু নির্মাণে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে কাজ শুরুর কথা থাকলেও তা করতে কয়েক মাস দেরি হয়ে যায়। যন্ত্রপাতি এনে পরীক্ষামূলক পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের মার্চে। এরপর ওই বছরের ডিসেম্বরে মূল সেতু নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলামও নির্দিষ্ট সময়েই কাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন। তিনি বলেন, মাটির বিভিন্ন রকম গঠন থাকে, সময়ে তা পরিবর্তিতও হয়। এ রকমই একটি বিষয় নিয়ে আমাদের এখন কাজ করতে হচ্ছে। শফিকুল বলেন, প্রয়োজনে জনবল ও যন্ত্রপাতি বাড়িয়ে হলেও নির্দিষ্ট সময়ই সেতুর কাজ শেষ করতে পারব বলে আমরা আশাবাদী।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্বিতল (সড়ক ও রেল) পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রধান অর্থায়নকারী বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে ‘সম্ভাব্য দুর্নীতির’ অভিযোগ তুললে বাংলাদেশ সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে। পরে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতুর ঘোষণা দিয়ে তা বাস্তবায়ন করছে সরকার। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র তদন্ত পর্যবেক্ষণে বিশ্বব্যাংকের হয়ে বাংলাদেশে আসা প্রতিনিধিদলের প্রধান লুই গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ অনেক অভিযোগ উঠেছে।
চুক্তি অনুযায়ী, ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকায় ৪৮ মাসের মধ্যে তাদের কাজ শেষ করার কথা। সে হিসাবে মূল সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে। আট হাজার ৭০৭ কোটি টাকায় নদী শাসনের জন্য চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১৪ সালের ১০ নভেম্বর। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রসিকিউটর থাকাকালে অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং করস্বর্গ (ট্যাক্স হেভেনস) নামে পরিচিত দেশ ও এলাকায় তার কোম্পানি থাকার তথ্য উঠে এসেছে ফাঁস হওয়া নথিতে।