** শত শত নারী ধর্ষণের কথা নিজেই প্রচার করে বেড়ায়
** বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্য তিনদশক আগে গ্রামের মসজিদ থেকে বহিষ্কার
** জায়গা-জমি দখলে ভাতিজা হত্যার অপচেষ্টা
** প্রথম স্ত্রী-সন্তান অধিকার না পেয়ে পথে পথে ঘুরছে
অবশেষে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলা থেকে পাকিস্তানি দরবারের খলিফা সেই করিম মাওলানাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তার সাথে আরো গ্রেফতার হয়েছে সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রী সালমা বেগম ও ছেলে কাউসার।
শনিবার (২৭ আগষ্ট) ভোররাতে মুরাদনগর উপজেলাধীন নবগঠিত বাঙ্গরা থানার ৪ নং পূর্বধৈর (পূর্ব) ইউনিয়নের হিরাপুর গ্রামের তার দখলীয় বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
লেখক-সাংবাদিক সাদেকুর রহমান হত্যা চেষ্টা মামলায় জামিনে এসে উল্টো হুমকি-ধমকি দিলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় কুমিল্লার স্থানীয় আদালত ৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। উক্ত মামলার অপরাপর আসামীরা হলেন করিমের তিন ভাই ইউনূস সরকার, কবির মিয়া ও হানিফ সরকার। পুলিশ এ তিনকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
বাঙ্গরা বাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেন করিম মাওলানা ও তার সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রী-ছেলেকে গ্রেফতার করার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, বাকী আসামীদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ইউনূস-করিম মাওলানা গং সাংবাদিক সাদেকুর রহমানের চাচা। তার পিতা ডা. এম এ. ওয়াহেদ সরকার ২০০৯ সালে ইন্তিকালের পর ভাইয়ের জায়গা-জমি আত্মসাতের নীলনকশা পাকাপোক্ত করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়। বাড়ি ও জমির অধিকার চাইতে গিয়ে ডা. এম এ ওয়াহেদ সরকারের পরিবারের জীবন আজ বিপন্ন। ডা. ওয়াহেদের দু’ ছেলেকে তারা বিভিন্ন সময় হত্যার চেষ্টা করে। সর্বশেষ গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ওয়াহেদের ছোট ছেলে সাংবাদিক সাদেকুর রহমানকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করে। এ ঘটনায় সাদেকুর রহমানের বড় শাহাদাত হোসেন বাদী হয়ে বাঙ্গরা বাজার থানায় একটি হত্যা চেষ্টা মামলা দায়ের করেন। ইউনূস-করিম গংকে অভিযুক্ত করে পুলিশ ইতিমধ্যে চার্জশীটও দিয়েছে। আইনের ফাঁক গলিয়ে এ মামলায় জামিনে বের হয়ে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। মামলার বাদীসহ মৃত ডা. ওয়াহেদ সরকারের পরিবারকে নির্মূল করার হুমকি-ধমকি দিতে থাকে আসামীরা। এ অবস্থায় বাদী আবারও আইনের আশ্রয় নিলে পুলিশ প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে কুমিল্লার সংশ্লিষ্ট আদালত করিম মাওলানাসহ উল্লেখিত আসামীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন।
এর প্রেক্ষিতেই বাঙ্গরা বাজার থানার পুলিশ গত শুক্রবার দিবাগত মধ্যরাতে অভিযান চালিয়ে হিরাপুর গ্রামের মৃত ডা. ওয়াহেদ সরকারের জায়গা দখল করে তোলা ঘর থেকে করিম ও তার ছোট সংসারের ছেলে কাউসারকে গ্রেফতার করে। পরে গতকাল শনিবার সকালে পুলিশ তার সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রী পরোয়ানাভুক্ত অপর আসামী সালমা বেগমকেও গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করে।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০১২ সালের ২৪ নবেম্বর জায়গা-জমি আত্মসাতের উদ্দেশ্যে ওয়াহেদের বড় ছেলে শাহাদাৎ হোসেনকে পানিতে চুবিয়ে হত্যার অপচেষ্টা করে করিম। ওই ঘটনায় তৎকালীন মুরাদনগর থানায় জিডি করলেও পুলিশ প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় করিম পার পেয়ে যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার নবগঠিত বাঙ্গরা থানাধীন ৪নং পূর্বধৈর (পূর্ব) ইউনিয়নের হিরাপুর গ্রামের মরহুম আশরাফ আলী সরকারের মেজো ছেলে মো. আ. করিম। আরবী শিক্ষা লাভের এক পর্যায়ে নিজের নাম বদলে রাখে মো. রেজাউল করিম। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি জামায়াতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। এরই মধ্যে করিম ১৯৯২-’৯৩ সালে পাকিস্তানের তৈয়্যেবিয়া কাদেরিয়া দরবার শরীফের বাংলাদেশে খলিফা নিযুক্ত হন এবং নামের শেষে ‘সুন্নী আল-কাদরী’ প্রতিস্থাপন করেন। এছাড়া নারী ধর্ষণ ও নিয়মিত গাঁজা সেবনসহ নানা অপকর্মের বদৌলতে লোকমুখে তার নাম হয়ে যায় ‘গাঞ্জা করিম’, ‘লুইচ্চা করিম’ ইত্যাদি। তবে নিজেকে তিনি ‘আল্লামা করিম’ পরিচয় বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
ভুক্তভোগী একাধিক নারীর স্বজনরা অভিযোগ করেন, মধুর কথার জালে পড়ে অনেকেই করিমের শরনাপন্ন হতো ধর্ম সম্পর্কে জানতে। এ সুযোগে তিনি বিশেষ করে বিধবা ও প্রবাসীদের স্ত্রীদের মুরিদ বানিয়ে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতেন। ৮/১০ বছর আগে পার্শ্ববর্তী খোশঘর গ্রামের দুই নারী তার যৌনলালসার শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়লে দুশ্চরিত্রবান করিমের মুখোশ খুলে যায়। এনিয়ে এলাকায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে দীর্ঘদিন তিনি আত্মগোপনে থাকেন। ঐ ঘটনায় তৎকালীন মুরাদনগর থানায় ধর্ষণ মামলা হলেও ৪নং পূর্বধৈর (পূর্ব) ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিনসহ স্থানীয় একটি মহলের মধ্যস্থতায় তা রফাদফা হয়। নারীলোভী করিম নিজেই দম্ভের সাথে প্রচার করে বেড়ায়, “আমার ১২শ’ বেটি (নারী) মুরিদ আছে। এর মধ্যে ৯শ’ জনের সাথে থাকছি (শারীরিক সম্পর্ক)। বাকি রইছে ৩শ’।” গত কুরবানীর ঈদের তৃতীয় দিন গ্রামের বাজারে অস্বাভাবিক অবস্থায় এসব বললে এলাকাবাসী ধাওয়া করে।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, করিম ১৯৮০’র দশকের শেষ দিকে হবিগঞ্জের উত্তর সাঙ্গর গ্রামের এক আলেমের মেয়েকে অন্য সংসার থেকে ফুঁসলিয়ে এনে বিয়ে করে। ঐ সংসারের একমাত্র মেয়ে শাহজাদী লাভলী (২৭) জানান, বহু বছর ধরে করিম তাদের কোন খোঁজখবর রাখেনা। তারা স্ত্রী-সন্তানের অধিকার না পেয়ে পথে পথে ঘুরছে। তার পিতার ভন্ডামীর কথা তিনি জানেন বলেও জানায় শাহজাদী লাভলী। করিম পরবর্তীতে প্রথম বিয়ে কথা গোপন রেখে বানিয়াচং উপজেলার বারৈপাড়ার রাবেয়া ও ইকরাম গ্রামের তনার মাকে বিয়ে করতে গেলে এলাকাবাসীর রোষানলে পড়ে ঐ এলাকা ত্যাগ করে। পরবর্তীতৈ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ, সুনামগঞ্জের শামারচর, কুমিল্লার বিভিন্ন অশিক্ষিত এলাকায় পীর-মুরীদের ব্যবসা শুরু করে। তবে কোথাও তিনি ধর্ম ব্যবসাকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পেরে তন্ত্র-মন্ত্রের পাশাপাশি চোরাচালানীর সাথে জড়িয়ে পড়েন। প্রায় তিনদশক আগে বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্য তাকে নিজ গ্রাম হিরাপুর জামে মসজিদ থেকে বহিষ্কার করেন এলাকাবাসী।
বিগত ২০০৯ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে করিম নিজেকে আওয়ামীলীগের কর্মী পরিচয় দিয়ে পাকিস্তানি দরবারের তরিকা প্রচারের পাশাপাশি আজমীর শরীফের নামে ভারতে যাতায়াত শুরু করেন। প্রতিবার ভারত থেকে ফিরে আসার পরই তার মধ্যে অধিকতর উগ্রতা দেখা যায়। তার সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রী সালমা বেগম ও এক চাচাতো ভাইয়ের (মৃত মাজু মিয়া) বিধবা স্ত্রী নেহারা খাতুনসহ আরো কয়েকজন নারীকে কৌশলে দলে ভিড়িয়ে করিম সন্দেহজনক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে প্রায় তিন সপ্তাহ আজমীর শরীফ যিয়ারতের নামে ভারতে অবস্থান করে। গ্রামে এসে করিম প্রায় রাতেই গ্রামের কবরস্থানের কাছে মুখঢাকা কিছু লোকের সাথে মিটিং করতো। তার রহস্যজনক গতিবিধির কারণে গ্রামের ধর্মপ্রাণ ও শান্তিপ্রিয় মানুষ করিমকে এড়িয়ে চলতে থাকে।
এদিকে, গত বছর ২৪ ডিসেম্বর দিবাগত গভীর রাতে তার পৈতৃক নিবাস হিরাপুর গ্রামের মধ্যপাড়া মৃত রহমান মেম্বারের বাড়িতে প্রশাসন এবং সহজ-সরল ও ধর্মপ্রাণ গ্রামবাসীর চোখ ফাঁকি দেয়ার কৌশল হিসেবে ‘শানে মোস্তফা শানে রিসালাত’ ব্যানারে ইসলামী জলসার আয়োজনের নাম করে করিম তার কিছু অনুগতকে জড়ো করে। ওই অনুষ্ঠানে পাকিস্তানী কাওয়ালী-গজল সহ কিছু আধুনিক ও মারফতী গান পরিবেশন করা হয়। এতে পাকিস্তানী শেরোয়ানি পরিহিত বেশ ক’জন বহিরাগত যোগ দিয়েছিল বলে জানা যায়। তথাকথিত ওই ইসলামী জলসা শেষে পাকিস্তানের তৈয়্যেবিয়া কাদেরিয়া দরবার শরীফের আদর্শ বাস্তবায়নে ‘তৈয়্যেবিয়া বাংলাদেশ মিশন (টিবিএম)’ নামে একটি সংগঠন গঠন করে রাষ্ট্র ও সরকার বিরোধী তৎপরতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। করিম ‘টিবিএম’ এর স্বঘোষিত আমীর বলে জানা গেছে। করিমের সর্বকণিষ্ঠ স্ত্রী সালমা বেগম ‘টিবিএম’ এর নারী শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে বলেও জানা গেছে।
মাওলানা করিমকে পারিবারিকভাবে সহযোগিতা করছেন তার দুই সহোদর বরখাস্তকৃত ইউপি মেম্বার ইউনূস সরকার ও হানিফ সরকার। ইউনূস ও হানিফ বিএনপির রাজনীতি করে। তাদের বিরুদ্ধে এলাকায় শান্তি-শৃংখলা বিনষ্ট করার অভিযোগ রয়েছে। তারা হিরাপুর গ্রামের বহুল আলোচিত মতিউর রহমান সরকার হত্যা ছাড়াও ডাকাতি, ধর্ষণ, অর্থ আত্মসাতসহ বেশ কয়েকটি মামলার আসামী। তারা নাশকতাসহ সরকার বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে বলে আশংকা করা হচ্ছে। এছাড়া হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং এলাকা, সুনামগঞ্জ জেলার শামারচর এলাকা, ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ ও বাঞ্ছারামপুর এলাকা, কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার খোশঘর, নবীয়াবাদ, কোরবানপুর, জানঘর, ডালপা, বাইড়া; দেবীদ্বার উপজেলার রসুলপুর, গোপালনগর ইত্যাদি এলাকায় উক্ত করিমের বহু অপকর্মের স্বাক্ষর পাওয়া যাবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
হিরাপুর গ্রামের বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. হাকিম মিয়া বলেন, লোকটা (করিম) এত নষ্ট যে ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। সে আসলে জামায়াতের লোক। সুবিধা আদায়ের জন্য এখন দল বদলাইছে। আমরা গ্রামের মানুষ আইন হাতে তুলে নিতে চাই না। প্রশাসনই এই শয়তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে বলে আমি আশা করি। আর তার ভাইয়েরাও এলাকায় নানাভাবে অশান্তি সৃষ্টি করে রাখে।
এ ব্যাপারে করিমের বহুল আলোচিত নারীঘটিত কেলেংকারীর সালিশ মীমাংশার অন্যতম মধ্যস্থতাকারী পার্শ্ববর্তী খোশঘর গ্রামের মকবুল ডিলার বলেন, উনি (মাওলানা করিম) আত্মীয়তার সম্পর্কে আমার মামা শ্বশুর হন। তাই মান-সম্মানের ভয়ে বিষয়টা যেমনে হোক ধামাচাপা দিছি। পাকিস্তানি দরবারের খলিফা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তার কর্মকান্ড নিয়ে আসলেই বিতর্ক আছে ।