জাতীয় ডেস্ক:
ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের জন্য উচ্চহারে সুদহারকে দায়ী করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন, এখনো যেসব ব্যাংক সুদহার এক অংকে নামায়নি, সেগুলোকেও নানা সুযোগ সুবিধা দিয়ে এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা হবে।
অনুষ্ঠানে অর্থবছরে রপ্তানি বাণিজ্যে অবদানের জন্য সেরা ৬৬ রপ্তানিকারককে সম্মানতা তুলে দেওয়া হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে নানা উদ্যোগ নিয়ে কথা বলেন। বিশেষভাবে তুলে ধরেন ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহারের বিষয়টি। বলেন, ‘অত বেশি সুদ দিয়ে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে গেলে খুব স্বাভাবিক যে ঋণখেলাপি হতেই হবে। কারণ, টাকা নেয়ার সাথে সাথেই তো আর ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হয় না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় এক লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। অবলোপন করা ঋণ ধরলে এই অংকটা দাঁড়ায় প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন, এখন থেকে এক পয়সাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না। কিন্তু তিনি কথা রাখতে পারেননি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি জানি ব্যাংকে ঋণ নিতে গেলে অনেক উচ্চহারে সুদ দিয়ে ঋণ নিতে হয়। ডাবল ডিজিটে। ইতিমধ্যে আমরা নির্দেশ দিয়েছি, ডাবল ডিজিটটা সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে হবে। কিছু কিছু ব্যাংক মেনেছে, কিছু কিছু ব্যাংক মানেনি এখনো। তবে সেটা আলাপ আলোচনা হচ্ছে এবং তাদের যা যা সুযোগ সুবিধা দেওয়ার, সেটাও আমরা করে যাচ্ছি এবং সেটাকে আমরা সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে চাই। এবং ইতিমধ্যে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছি, যাতে করে বিনিয়োগটা সহজ হয়।’
সরকার ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়ে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ করতে চায় বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের পাশে আছি। আমি ব্যবসা করি না, আমাদের সরকার ব্যবসা করতে আসেনি। আমরা এসেছে ব্যবসায়ীদের সব রকমের সহযোগিতা দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য যাতে আরো সম্প্রসারিত হয়, আর্থিকভাবে বাংলাদেশ যেন আরো শক্তিশালী হয়, বাংলাদেশে মানুষ যেন উন্নত জীবন পায়, জাতির পিতার যে স্বপ্ন, ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ যেন আমরা গড়ে তুলতে পারি, সেই লক্ষ্য নিয়েই আমাদের সরকার কাজ করে যাচ্ছে।’
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলোও একে একে দূর করা হচ্ছে বলেও জানান শেখ হাসিনা। তুলে ধরেন বিদ্যুৎ খাতের ব্যাপক উন্নয়ন, গ্যাস আমদানি, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার কথা।
‘আর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেকগুলো ধাপ পার হতে হতো। অনেকগুলো সমস্যা ছিল। একে একে সেগুলোতে আমরা কমিয়ে এনে সহজভাবে যাতে বিনিয়োগ হতে পারে বা কেউ বিনিয়োগ করতে চাইলে রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে সেটাও একেবারে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন যেন হয়… অর্থাৎ তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারটা যাতে এখানে হয়, সে ব্যবস্থাটাও আমরা নিয়েছি।’
‘আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ দপ্তরে অনলাইন লাইসেন্সিং-ওএলএফ চালু করা হয়েছে। কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য অনলাইন ব্যবস্থা আমরা চালু করে দিয়েছি।’
‘আগে কোম্পানি করতে গেলে কয়েকজন পার্টনার লাগত। এখন কিন্তু এক ব্যক্তি একটা কোম্পানি করতে পারে। সব ধরনের সুবিধাই আমরা করে দিচ্ছি এবং রেজিস্ট্রেশন ফিসহ সকল ফি আমরা ইতিমধ্যে কমিয়ে দিয়েছি। কারণ, আমরা চাই নতুন নতুন এন্টারপ্রিনিয়র গড়ে উঠুক। বিশেষ করে আমাদের যুব সমাজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হোক।’
‘আমাদের যে কোম্পানি আইন আছে, সেটাকেও যুগোপযোগী করার পদক্ষেপ নিয়েছি, সংস্কার করে সেটাকেও আমরা আরো উন্নতমানের করব।’
শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টি নিয়ে আগেভাগেই কাজ করার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘এই ব্যবস্থাপনা যদি শুরু থেকেই করেন, তাহলে পরিবেশ রক্ষায় অত্যন্ত ভালো হবে, দেশের জন্য সেটা কল্যাণকর হবে এবং মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে।’
সেই সঙ্গে প্রতিটি শিল্পাঞ্চলে জলাধার রাখার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘বৃষ্টির পানি সেখানে সংরক্ষণ করা যায়। যতগুলো স্থাপনা হবে বা বিল্ডিং হবে, বৃষ্টির পানিটা যেন এই জলাধারে সঞ্চিত হয়; যাতে আগুন লাগলে বা দুর্ঘটনা হলে যেন সে পানিটা সেখানে ব্যবহার করা যায়।’
বাণিজ্য বসতে লক্ষ্মী-এটাকে মাথায় রেখেই বাণিজ্য বাড়ানোর তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী। দেন রপ্তানি বাড়াতে পণ্যের বহুমুখীকরণেরও পরামর্শ। বলেন, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কোন দেশে কোন জাতীয় পণ্যের চাহিদা বেশি, সে দিকটায় বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।’
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ডব্লিউটিও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ওষুধের মেধাস্বত্ত্ব যে মেয়াদ দেয়, সেটা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বাড়ানোয় ওষুধ ও কাঁচাপণ্য রপ্তানির সুযোগ এসেছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। জানান, সেবাখাতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে দেওয়া বিশেষ সুবিধার দেয়ামও বেড়েছে ২০৩০ সাল পর্যন্ত।
বাংলাদেশের উন্নয়নে একশ বছরের ডেল্টা প্ল্যানের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘চিরদিন তো আর কোনো মানুষ বাঁচে না। কিন্তু আজকে যে উন্নয়নের গতিটা, সেটা যেন থেমে না যায়, স্বাধীন বাংলাদেশ যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।’
বাংলাদেশকে নিয়ে আগে যারা কটাক্ষ করেছে, তারাই এখন প্রশংসায় ভাসাচ্ছে- বলেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তীতে যারা স্বাধীন বাংলাদেশকে নিয়ে নানা ধরনের কথা বলেছিল যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেটকেস হবে, আজকে কিন্তু তারা বাংলাদেশকে অবহেলার চোখে দেখতে পারে না। আজকে বাংলাদেশকে তাদের সম্মানের চোখেই দেখতে হয়, যে বাংলাদেশও পারে।’
‘যে দেশ থেকে আমরা দেশকে মুক্ত করেছিলাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, তারা একবার বলেছিল তখন যে, ঠিক আছে বাংলাদেশের মানুষ শুধু গরিব, এত লোক, ওটা একটা বোঝা ছিল, চলে গেছে ভালো। আজকে তারা বলতে বাধ্য হয়, হামকো বাংলাদেশ বানাদো। অর্থাৎ আমাদেরকে বাংলাদেশের মতো উন্নত করে দাও, সেটা বলতেও তারা বাধ্য হয়।’