জাতীয় ডেস্কঃ
আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনসহ দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার ঘোরে এদিক-ওদিক দুলছে। দেশ কি আবারও পাঁচ জানুয়ারির মতো নির্বাচনের দিকে হাঁটছে, নাকি বিএনপিসহ উল্লেখযোগ্য দলগুলোকে নিয়ে অংশীদারমূলক ভোটযুদ্ধ হবে-দেশের সামনে এটি এখন বিশাল প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। ক্ষমতাসীনরা চাইলেও কী দশম সংসদের আদলে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব? খোদ সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ সূত্রগুলোও এমনটা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। আবার উন্নয়ন-রূপরেখার পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য ক্ষমতার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সরকার কি সবার অংশগ্রহণে ‘সুষ্ঠু-স্বাভাবিক’ ভোটের লড়াইয়ে যেতে পারবে? আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এমন প্রশ্ন তুললে বাস্তবতা বিবেচনায় তারাও চুপসে যান। অন্যদিকে, নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এখন পর্যন্ত শুধু বিপরীত অবস্থানেই নেই, বরং গত তিন বছরে দু’পক্ষ বিপরীত দিকে সরে গেছে আরও বহু পথ।
এ অবস্থায় সামনের দিনগুলোর গতিপথ কেমন হবে? এ নিয়ে গতকাল সোমবার ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি অনাকাঙ্ক্ষিত। কেননা ওই নির্বাচন আইনগতভাবে বৈধ হলেও নৈতিকভাবে ‘অবৈধ’। আমরা সবাই যদি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটিকে সুস্থ-স্বাভাবিক রাখতে চাই, তাহলে অবশ্যই একাদশ সংসদ নির্বাচনটি অংশীদারমূলক করতে হবে। রাজনীতিতে যে ঘোর অনিশ্চয়তা ভর করে বসে আছে, সেটিকে কাটাতে হলে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হতেই হবে। অন্যথায় দেশে অরাজনৈতিক বিকল্প ভর করতে পারে।
এদিকে, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার দাবি আংশিক বা সম্পূর্ণ পূরণ না হলে বিএনপি দশমের মতো একাদশ সংসদ নির্বাচনও বর্জন করবে, নাকি কোনো অবস্থাতেই একাদশে আর ওয়াকওভার দেবে না- এর কোনটিই এখনও সুনির্দিষ্ট করেনি দলটি। বরং নির্বাচনকে সামনে রেখে সব ধরনের বক্তব্যই রেখে যাচ্ছে বিএনপি নেতৃত্ব। এসব বক্তব্যের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে আগামীতেও নির্বাচনে না যাওয়া, বিএনপিকে বাইরে রেখে পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচন হতে না দেওয়া- উভয় ধরনের বার্তারই সন্ধান মেলে।
বিএনপি চেয়ারপারসন রবিবারও ঢাকায় এক ইফতার অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ জরিপ চালিয়ে নিজেদের হার আঁচ করতে পেরে আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে বাদ দিতে চাচ্ছে। তারা চায় না বিএনপি নির্বাচনে আসুক। বিএনপি নির্বাচনে এলে তাদের যে কী পরিণতি হবে, তারা গোপন খবর নিয়ে জেনে গেছে। তাদের অবস্থান কত নিচে, সেটা তারা বুঝে গেছে। সেজন্যই তারা নানাভাবে হয়রানি করছে, যাতে বিএনপি নির্বাচন না আসে, বিএনপির লোকজনকে কিভাবে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা যায়। আমি সুস্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই, বিএনপিকে বাদ দিয়ে এদেশে কোনো নির্বাচন হবে না, হতে দেওয়া হবে না।’ দু’দিন আগে আরেক ইফতার অনুষ্ঠানে বিএনপি প্রধান বলেছেন ‘শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না, নির্বাচন হবে সহায়ক সরকারের অধীনে, বিএনপি শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না।’
আগামী নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির এমন ‘অস্পষ্ট’ অবস্থানের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শুক্রবার মুন্সিগঞ্জে বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া একদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে চান না, আরেকদিকে বলেন ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেবেন না। বিএনপি আসলে কী চায় তা তারা নিজেরাও জানেন না।’ আর ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নির্বাচন তো সরকার করবে না, নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন। সুতরাং নির্বাচনের সময় কে সরকারে থাকলো সেটা বিষয় নয়। তাছাড়া কার অধীনে, কখন, কীভাবে নির্বাচন হবে-সেটি তো সংবিধানেই বলা আছে। এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই।’
মূল দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের এমন বৈরি অবস্থানের প্রেক্ষাপটে আগামী নির্বাচনকালীন অনিশ্চয়তার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহিদুজ্জামান গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন, নিরপেক্ষ, নির্দলীয় বা সহায়ক- যে ধরনের সরকারের কথাই বলুক না কেন, আমার মতে-বিএনপির এই দাবির এখন আর তেমন কোনো ভিত্তি নেই। আগামী নির্বাচনও শেষ পর্যন্ত এই সরকারের অধীনেই হবে। আমরা দেখছি, নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি নেতাদের সারাদেশে জনসংযোগে আগ্রহ কম। ইফতার পার্টি আর সংবাদ সম্মেলনেই সময় অপচয় করছে তারা। পরে দেখা যাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দৌড়াদৌড়ি করবে, এসব করে লাভ হবে না। আগামী নির্বাচনও না করলে কিংবা দেশে যদি নির্বাচন না হয় তাহলে বিএনপি শেষ হয়ে যাবে।’
রাজপথের কর্মসূচি থেকে বর্তমানে দূরে থাকা বিএনপি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের অধীনে ভোটের দাবিতে আসন্ন রোজার ঈদের পর অহিংস আন্দোলনের কথাও বলছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া শনিবার বলেছেন, ‘ঈদের পর বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নামবে।’
বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ নাগাদ রাজপথে আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে বিএনপি জোট। বিএনপির আন্দোলনের পরিকল্পনা সম্পর্কে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করবে এটা যদি সত্য হয়, তা আরব্য রজনীর রূপকথাতেও হয় না। বিএনপি আট বছর ধরে রোজার ঈদের পর, কোরবানির ঈদের পর, এসএসসি পরীক্ষার পর আন্দোলন বলেই আসছে। আমরা জানতে চাই, এইবারের আন্দোলন কোন ঈদের পর হবে? আর সেটা কোন বছর? আসলে আন্দোলন করার মত সামর্থ্য বিএনপির নেই।’
নির্বাচনের এখনও দেড় বছরের মত সময় বাকি থাকলেও প্রভাবশালী দেশগুলোরও তত্পরতা এখন থেকেই লক্ষ্যনীয়। সম্প্রতি ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে. এম. নুরুল হুদার সঙ্গে সাক্ষাত্ করে সবার অংশগ্রহণে আগামী সংসদ নির্বাচন নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তার এই অবস্থানের সঙ্গে একমত পোষণ করে সিইসিও বলেছেন, বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন আর নয়, এজন্য কমিশন এখন থেকেই কাজ শুরু করেছে। বার্নিকাটের পরে সিইসি নুরুল হুদার সঙ্গে বৈঠক করেছেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক। বৈঠক শেষে ব্লেক গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশে অন্তর্ভূক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত এবং যারা এ লক্ষ্যে কাজ করছে তাদেরকে সমর্থন জানাতে এসেছি।’ এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) একাধিকবার আগামীতে সবার অংশগ্রহণে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের উপর গুরুত্ব দিয়েছে।
ভোটের দেড়-দুই বছর আগে থেকে বিদেশিদের এ আগাম তাগিদের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘যে সকল কূটনীতিক আমাদের দেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, তাদের উদ্দেশে আমি বলতে চাই-নিজ নিজ দেশের চেহারাটা আগে দেখুন, আয়নায় নিজেদের দেখুন, নিজ দেশ নিয়ে মাথা ঘামান।’
ওবায়দুল কাদের এমন প্রতিক্রিয়া জানালেও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়। বাংলাদেশ বিশ্ব কমিউনিটিরই অংশ। বিদেশিরা সুষ্ঠু নির্বাচনে সহযোগিতার কথা বলছেন, তাদের সহযোগিতা আমরা অতীতেও নিয়েছি। তাহলে এখন কেন দ্বি-চারিতা! তাছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে তাদেরও যৌক্তিক মাথাব্যাথ্যা রয়েছে। কারণ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এখানকার পরিস্থিতি তাদের দেশেও প্রভাব ফেলে। যেমনটা এবার আমরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দেখছি।
ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে ড. বদিউল আরও বলেন, পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনের পর পদ্মার জল অনেকদূর গড়িয়েছে। বিশ্ব প্রেক্ষাপটও জটিল হয়েছে। প্রতিবেশি রাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা দেশগুলোতে উদ্ভুত অস্থিরতার প্রভাবমুক্ত আমরাও নই। উগ্র-জঙ্গিবাদও আমাদেরসহ বিশ্বের সামনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। কাজেই আমাদের সাবধান হতে হবে। এরকম পরিস্থিতিতে সরকার চাইলে আবার পাঁচ জানুয়ারির মত নির্বাচন করে ফেলতে পারে, তবে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। দেশ ও জনগণের স্বার্থে এই অনিশ্চয়তা থেকে আমাদের বের হয়ে আসার পথ খুঁজতে হবে।
রাজনীতি-বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, আগামী নির্বাচন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের জন্যই এক ধরনের ‘বাঁচা-মরার’ লড়াই। স্বাভাবিক ভোটে বিএনপি জিতলে আওয়ামী লীগের টিকে থাকা যেমন চ্যালেঞ্জে পড়বে, তেমনি আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় থাকলে বিএনপির সংকটও গভীরতম হবে।
ইত্তেফাক