অন্তর্জাতিক ডেস্কঃ
নারীদের গাড়ি চালানোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পর গত বছর বিশ্বজুড়ে সৌদি আরবের প্রশংসা করা হয়। কিন্তু দেশটিতে নারীদের ওপর এখনো অনেক ধরনের বিধিনিষেধ চালু আছে। এর অন্যতম হচ্ছে পুরুষ অভিভাবকতন্ত্র। যেখানে একজন নারীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো তিনি নিজে নিতে পারেন না। তার পক্ষ হয়ে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন শুধু তার বাবা, ভাই, স্বামী কিংবা ছেলে।
একজন সৌদি নারীকে তার পাসপোর্টে আবেদনের জন্য, বিদেশে যাওয়ার জন্য, সরকারি বৃত্তি নিয়ে বিদেশে পড়াশোনার জন্য, বিয়ে করার জন্য, এমনকি কারাগার ছেড়ে যাওয়ার জন্যও তার পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি নিতে হয়। এ বিষয়ে মিশরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন সাংবাদিক মোনা এলতাহাউই বলেন, ‘এটা এমন একটা বিষয় যা প্রত্যেক সৌদি নারী এবং মেয়েকে জন্ম থেকে আমৃত্যু ভোগায়। এর মাধ্যমে নারীকে মূলত একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হিসেবে দেখা হয়।’
সৌদি আরব নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের সনদে সই করেছে। সৌদি সরকার বলে থাকে শরিয়া আইনে লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করা হয়েছে। নারী ও মেয়ে শিশুদের খেলাধুলার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে সৌদি। পাশাপাশি নারীদের স্টেডিয়ামে বসে ফুটবল খেলা উপভোগেরও অনুমতি দিয়েছে। তবে নারীদের বিরুদ্ধে বৈষম্য রোধে কোন আইন না থাকায় এবং সৌদি সরকার বৈষম্যের কোন আইনগত সংজ্ঞা তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়ায় জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা গত বছর উদ্বেগ প্রকাশ করে।
সৌদি পুরুষ অভিভাবকত্ব ব্যবস্থাকে সমাজ ও দেশের অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বড় বাধা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০১৬ সালের এক রিপোর্টে বলা হয়, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে সৌদি আরবে স্পষ্ট এবং প্রত্যক্ষভাবে অভিভাবকত্ব আইন প্রয়োগ করা হয়।’
এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য বেশ কয়েকজন নারীর বিচার করা হয়েছে এবং জেলে পোরা হয়েছে। সৌদি মানবাধিকার কর্মী সামার বাদাউই তার বাবার বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ এনে ২০০৮ সালে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান এবং এক আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নেন। এরপর বাবার অভিভাবকত্ব বাতিলের জন্য তিনি আদালতে মামলা দায়ের করেন। তার বাবাও মেয়ের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়ের করে বলেন, সামার বাবার অবাধ্য মেয়ে।
এক সৌদি আদালত ২০১০ সালে সামার বাদাউইকে কারাদণ্ড দেয় এবং তিনি সাত মাস আটক ছিলেন। সৌদি মানবাধিকার কর্মীরা বিষয়টিতে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মামলা প্রত্যাহার করা হয়। পিতার অবাধ্যতার অভিযোগে মারিয়াম আল ওতাইবি নামে আরেক সৌদি নারীকেও ২০১৭ সালে তিন মাসের কারাদ- দেয়া হয়।
সৌদি নারী অধিকার কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে পুরুষ অভিভাবকত্ব ব্যবস্থা বাতিল করার আবেদন জানিয়ে আসছিলেন। সৌদি নারীরা পুরুষ অভিভাবকত্ব ব্যবস্থা চায় না বলে টুইটারে বড় ধরনের এক আন্দোলন শুরু হয়। এই প্রথা বাতিলের দাবি করে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সৌদি বাদশাহর দরবারে ১৪ হাজার স্বাক্ষরসহ এক আবেদন পেশ করা হয়। সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি আব্দুল আজিজ আল শেখ ওই আবেদনপত্রকে ইসলামের বিরুদ্ধে অপরাধ এবং সৌদি সমাজ ব্যবস্থার ওপর মরণ আঘাত বলে বর্ণনা করেন।
এর পাঁচ মাস পর সৌদি বাদশাহ এক আদেশ জারি করেন যেখানে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে অভিভাবকত্ব প্রথার প্রয়োজন হবে না বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু ২০১৮ সালে নারীদের গাড়ি চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে সৌদি আরবে নারী অধিকার আন্দোলনকারীদের ধরপাকড় শুরু হয়। আটককৃতদের বিরুদ্ধে বিদেশি শক্তির সন্দেহজনক যোগাযোগসহ বেশ কিছু অভিযোগ আনা হয়। বিচারে এদের দীর্ঘমেয়াদী সাজা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।