কুমিল্লা প্রতিনিধি
চাঁন মিয়া বয়াতি। তিনি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার জয়নগর গ্রামের রঙ্গু মিয়ার ছেলে। জন্মতেই অন্ধ এ বয়াতির কথায় আছে ছন্দ আর কণ্ঠে মধুর সুর। এমন প্রতিভার অধিকারী হয়েও যেন কিছুই নেই তার। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক চাঁন মিয়া। ছয় সদস্যের সংসারে একমাত্র স্ত্রী ছাড়া পাঁচজনই জন্মগতভাবে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। অদম্য মনোবল আর শক্তি-সাহস নিয়ে মনের আলোয় জীবনের বাঁকে বাঁকে পথ চলেন তারা। পরিবারের ভরণ-পোষণসহ সকল ব্যয়-ভার চালানোর একমাত্র সম্বল বয়াতির কণ্ঠ।
চাঁন মিয়া বয়াতির বাবা রঙ্গু মিয়াও ছিলেন গুণী বয়াতি (শিল্পী) এবং জন্মগতভাবে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। ছয় ভাই বোনের মধ্যে চাঁন মিয়া ও তার দুই বোন ছিলেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। চার বছর আগে মারা যান রঙ্গু মিয়া বয়াতি। শিশুকাল থেকে চাঁন মিয়া তার বাবার অতি আদরের ছিলেন। বাবার সান্নিধ্যে দিনে দিনে তিনিও বয়াতি হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেন। আজন্ম জন্মান্ধ চাঁন মিয়া তার বাবার চলার পথ অনুসরণ করে হাটে-বাজারে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়ে উপার্জিত আয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পান।
স্ত্রী পেয়ারা বেগম, সন্তান রহিমা বেগম (১৮), রাসেল মিয়া (১৬), সুমী আক্তার (১৪), রাকিব মিয়া (১২)সহ পরিবারের পাঁচজনই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। এর মধ্যে চাঁন মিয়া ও তাঁর দুই মেয়ে মাসিক ছয়শ টাকা করে সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন। এছাড়া সরকারিভাবে পাওয়া এক চিলতে জায়গায় মাটির ঘর নির্মাণ করে পরিবার নিয়ে তিনি বসবাস করছেন। তার স্বপ্ন ছিল সন্তানদের প্রতিবন্ধী স্কুলে পড়ানোর, কিন্তু অভাবের কারণে আশা পূরণ হয়নি।
স্থানীয়রা জানান, চাঁন মিয়ার সুরেলা কণ্ঠে যাদু আছে। তিনি যে কাউকে নিয়ে কিংবা যে কোনো বিষয়ে গান বাঁধতে পারেন। তাই যে কোনো স্থানীয় কিংবা জাতীয় নির্বাচনের সময় চাঁন মিয়া বয়াতির কদর অনেক বেড়ে যায়। নাম বলে দিলে সুরে সুরে প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়ে গান গেয়ে মাতিয়ে তোলেন। এতে কম-বেশি উপার্জনও জোটে। ওই সময় অনেক নেতার নিকট থেকে তিনি নানা প্রতিশ্রুতিও পান।
কিন্তু ভোট আসে, ভোট চলে যায়, অনেকে নেতা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতাবান হন- এরপর কেউ আর খোঁজ রাখে না চাঁন মিয়ার। ছেলে-মেয়েরা বড় হচ্ছে, তাদের বিয়ে ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় দিন কাটছে। চোখের আলো না থাকায় অন্যের সাহায্য নিয়ে আমাদের পথ চলতে হয়। অর্থাভাবে ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা করিয়ে তাদের মাঝে জ্ঞানের আলো জ্বালাতে পারিনি- এটাই জীবনের অনেক বড় অতৃপ্তি।