ফয়সল আহমেদ খান,বাঞ্ছারামপুর (বি-বাড়িয়া) থেকে:
আদিকালে থেকে নারীরা কৃষিকাজের সূচনা করেছিল। সেই নারীরা আজো সম্পৃক্ত আছে কৃষি কাজের সাথে। কেবল কৃষি কাজই নয় দিনের পর দিন বেড়েছে নারী শ্রমিকদের কর্মপরিধি, কিন্তু বাড়েনি তাদের পারিশ্রমিক। নানা অবহেলায়, পরনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে না থেকে স্বাবলম্বী হয়ে বেঁচে থাকার তাগিদেই নারীরা বিভিন্ন কাজের সাথে যুক্ত হচ্ছেন।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর কর্মক্ষেত্র একসময় চার দেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বলতে গেলে, গৃহস্থালি কাজ, সন্তানদের খাওয়া-নাওয়াই ছিল নারীরের মুখ্য কাজ। গৃহস্থালি কাজ ঘিরে অবদানের বাইরে নারীদের তেমন বিচরণ ছিল না। আজ সেদিন অতীত। এখন স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, ব্যাংক-বীমায় ও পুলিশ, সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে নারীরা ভালো কাজের স্বীকৃতিও অর্জন করছেন। অর্থনীতিতে নারীর অবদান এখন অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়েও বেশি। রফতানি আয়ের বড় খাত পোশাক শিল্পে নারীদের কর্মনৈপুণ্য, আন্তরিকতা, মেধা ও শ্রমের বিনিময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাকের কদর বেড়েছে। যে শিল্পে ৪০ লাখেরও বেশি কর্মী নিয়োজিত, যার ৮০ শতাংশই নারী।
সরেজমিনেঃব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর সদর উপজেলার খোষকান্দি গ্রামের জনৈক প্রবাসীর বাড়ির ৩ তালা দালানের ছাদ ঢালাই হবে।মহা আয়োজন।৫৭ জন শ্রমীক। যার বেশীর ভাগই নারী।সকাল ৮টায় শুরু দুপুর ৩ টায় শেষ।পুরুষ শ্রমীকদের তাদের মহাজন দুলাল মিয়া দিচ্ছেন ৩’শ টাকা করে।কিন্তু নারীদের দেয়া হলো ২’শত টাকা।দুপুরে খাবার দেয়া হলো।নারীদের ভাতের সাথে দেয়া হলো ফার্মের মুরগীর মাংস ও ডাল এবং পুরুষদের দেয়া হলো গরুর মাংস,ডাল।এখানেও বৈষম্য।
নারী শ্রমীক মনোয়ারা বেগম বলেন,-‘‘দেখলেন তো সাংবাদিক সাব।সারাদিন পুরুষদের চেয়ে আমরা মহিলারা বেশী শ্রম দিলাম।ঢালাই কাজে বিরতি থাকে না। বিশ্রাম বা হাফ ছাড়বো সে উপায়ও নেই।এতোকিছুর পরও কিন্তু পুরুষ শ্রমীকরা সিগারেট আর চা খাওয়ার বাহানায় ১৫-২০মিনিট ফাকি দিয়েছে।ঐ সময় আমি সহ আমাদের সব নারী শ্রমীকদের উপর চাপ দ্বিগুন হয়।নীচতলা থেকে ৩ তালার ছাদে মাথায় করে কড়াই-এর ভেতর ইটের সুরকী,বালি,সিমেন্টের মিশ্রনের ঢালাইয়ের কাজ বহু পরিশ্রমের।কিন্তু আমাদের ১’শ টাকা কম দেয়া হলো পুরুষদের তুলনায়।এই নিয়ম কোন কালে শেষ হবে?’’
ঘুরেফিরে বিকেলে গেলাম হোমনার ঝগড়ার চরে।সেখানে ইরি জমিতে চারাগাছ লাগাচ্ছে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও।অনেকের সাথে মজুরী নিয়ে কথা বললাম।একই অভিযোগ।নারীদের মধ্যে আফিয়া বেগম বললেন,-‘‘আমরা শ্রম দেই বেশী।৩০ শতাংশ জমিতে ইরি ধানের চারা (স্থানীয় ভাষায় বলা হয় জ্বালা)৮জন পুরুষ লাগাতে সময় নেয় ৬ ঘন্টা।আমরা নারীরা তা ৪ ঘন্টায় পারি। কারন,আমরা কাজে ফাঁকি দেই না।বিশ্রাম,গল্প,বিড়ি-সিগারেট-চা খাওয়ার বাহানা করিনা।তবুও তাদের দৈনিক মজুরী দেয়া হয় ৩’শ টাকা।নারী মানে আমাদের দেয়া হয় ২’শত টাকা করে।এই নিয়ম কি পরিববর্তন হবে না?’
নারী-পুরুষের মতো ধনী-গরীবের বৈষম্যর পরিস্থিতি একই।গ্রাম-গঞ্জে সাম্প্রতিক সময়ে ধনী-গরীব বৈষম্য দিন-কি দিন বেড়েই চলেছে।মফস্বলে নিরক্ষর ও গরিব মানুষের সংখ্যাই অধিক। দারিদ্রতার আর্তনাদ তাদের চেহারায় ভেসে ওঠে! গাঁয়ে ক্ষমতাশালী, অনেক টাকাওয়ালা ছিলেন ও আছেন। তবুও সে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ, কী মানবেতর জীবন পার করছে ও নানা সমস্যার যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে! বুর্জোয়া রাজনীতির দূষণে আজ গ্রাম্য জীবনেও ধস নেমেছে! পারিবারিক ভাঙন, ঝগড়া-ঝাটি, অসভ্য গালি-গালাজ, অভদ্র ব্যবহার, আলোহীন শিক্ষা, নৈতিক অধঃপতন, মহাজন ও এনজিও’র ছোবল, ধনী- গরিবের বৈষম্য বৃদ্ধি, সমাজপতিদের দৌরাত্ম্য, বাল্যবিবাহে বাধা দিয়ে টাকা আত্মসাৎ, রাজনীতিকে ব্যবসায় পরিণত, চর্চাহীন ও নীতিহীন রাজনীতি, চাঁদা-ঘুষ আদায় ও ভোট দেয়ার মতো ন্যূনতম অধিকার হরণসহ এমন কোনো অন্যায় নেই- যা আজ সে গ্রামে হয় না। ‘ধর্মীয় হিংসা’- কারন হিসেবে চিহ্নিত হয়,-যা একেবারে মিথ্যে।
আসলেই অনেকে জানেন না আমাদের যেসব কাজ গ্রামে-গঞ্জে রয়েছে তার কোন জাতীয় মূল্য রয়েছে কিনা। আমাদের পরিচিতজনেরা দেখে মুগ্ধ্ব হন এবং আক্ষেপ করেন প্রচার নাই কেন!
বেগুন ও আলুর মধ্যে পুষ্টিগুন ও বিদ্যমান। নারীদের জন্যে বিশেষ করে এই সব্জি খুব উপকারী। সবমিলিয়ে বেগুন ও আলু মানুষের অতি প্রিয় সব্জি – ধনী গরিব সবাই নানাভাবে এই সব্জি খান।শ্রমিক হিসেবে নারী স্বীকৃত কিনা, তার মজুরী বৈষম্য কেন ঘটছে, বা মুল অর্থনীতিতে নারীর ভুমিকা কি সেটা বারে বারে প্রশ্ন ওঠে, কিন্তু কোন সুরাহা হয় না। কিছুটা পাওনা আদায় করা গেলেও পুরুষ শ্রমিকের সমান বা আন্তর্জাতিক মানের কোন কাঠামোতে নারীকে ধরা হয় না।