দেবিদ্বার (কুমিল্লা) প্রতিনিধিঃ
লাইলী আক্তারের সঙ্গে বাবা আমির হোসেনকে আপত্তিকর অবস্থা দেখে ফেলাই কাল হলো শিশু ফাহিমা আক্তারের জন্য। নিজের অনৈতিক সম্পর্ক আড়াই করতেই পরিকল্পিতভাবে নিজের শিশু সন্তানকে হত্যা করেন আমির হোসেন। মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর) দিবাগত রাতে কুমিল্লার দেবিদ্বার ও রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় অভিযান চালিয়ে আমির হোসেন ও লাইলী আক্তারসহ ৫ জনকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তারা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয় (র্যাব)-এর কাছে এই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
গ্রেফতার বাকি তিন আসমি হলেন, মো. রবিউল আউয়াল, মো. রেজাউল ইসলাম ইমন ও মো. সোহেল রানা।
এ প্রসঙ্গে বুধবার (১৭ নভেম্বর) দুপুরে র্যাবের কাওরানবাজার র্যাবের মিডিয়া সেন্টারের আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-এর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদের সময় আসামিরা জানায়, ভিকটিমের বাবা মো. আমির হোসেনের সঙ্গে লাইলি আক্তারের পরকিয়া সম্পর্ক রয়েছে। গত ৫ নভেম্বর লাইলি আক্তার ও আমির হোসেনকে মেয়ে ফাহিমা আক্তার আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে। এতে লাইলি আক্তার ও আমির হোসেন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। বিষয়টি যেন কেউ জানতে না পারে, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আমির হোসেনকে চাপ দিতে থাকে। লাইলি আক্তারের প্ররোচনায় গত ৬ নভেম্বর আমির হোসেন তার সহযোগীদের নিয়ে ফাহিমা আক্তারকে হত্যার পরিকল্পনা করে। এরপর এই পরিকল্পনার কথা লাইলি আক্তারকে জানায়।’
খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, ‘লাইলি আক্তারকে নিয়ে আমির হোসেন আরও পরিকল্পনা করে, মেয়েকে হত্যার পর স্ত্রীকে ডিভোর্স দেবে। অথবা স্ত্রীকে হত্যা করে হলেও লাইলি আক্তারকে বিয়ে করবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ৬ নভেম্বর রাতে মো. রেজাউল ইসলাম ইমনের ফার্নিচার দোকানে আমির হোসেন টাকার বিনিময়ে মো. রবিউল আউয়াল, মো. রেজাউল ইসলাম ইমন ও মো. সোহেল রানাকে সঙ্গে নিয়ে ফাহিমা আক্তারকে হত্যার জন্য পরিকল্পনা করে।’
সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মুখপাত্র বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যার জন্য ধারালো ছুরি ও হত্যার পর লাশ লুকানোর জন্য দুটি প্লাস্টিকের বস্তা সংগ্রহ করে আমির হোসেনরা। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ৭ নভেম্বর বিকেল আনুমানিক ৩ টা ১০ মিনিটে কৌশলে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে শিশু ফাহিমাকে নিয়ে তারা বাড়ি থেকে বের হয়। এরপর চাঁপানগর রাস্তার মোড়ে সোহেল রানার সিএনজিতে করে মো. আমির হোসেন ও তার অন্য সহযোগীরা ফাহিমাকে নিয়ে রওনা দেয়। সিএনজিতে বিভিন্ন স্থানে ঘোরাফেরা করে সন্ধ্যা আনুমানিক ৮টা ৩০ মিনিটে দেবিদ্বার পুরান বাজারের দক্ষিণে নদীর তীরবর্তী নির্জন স্থানে ফাহিমাকে নিয়ে যায়।’
র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর লাইলি আক্তারের উপস্থিতিতে আমির হোসেন তার মেয়ে ফাহিমার মুখ চেপে ধরে প্রথমে নিজে মেয়েকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। এরপর রবিউল ভিকটিমের পায়ে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। রেজাউল ইসলাম ইমন ছুরি দিয়ে ভিকটিমের পায়ে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে। সোহেল ছুরি দিয়ে ভিকটিমের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। পরবর্তী সময়ে সহযোগীরা ভিকটিমের হাত-পা চেপে ধরে রাখে। আর আমির হোসেন মেয়ের গলা চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। হঠাৎ করে ঘটনাস্থলের আশেপাশে সম্ভাব্য লোকজনের চলাচল আঁচ করে লাশটি প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে সিএনজিতে করে রওনা করে। পথিমধ্যে সুবিধাজনক স্থান না পেয়ে লাশটি গরুর ঘরে ড্রামের ভেতরে লুকিয়ে রাখে রেজাইল ইসলাম ইমন।
আল মঈন বলেন, ‘গত ৯ নভেম্বর রাতে সোহেল রানার সিএনজিতে করে মো. আমির হোসেন, রবিউল আউয়াল, মো. রেজাউল ইসলাম ইমন ভিকটিমের বস্তাবন্দি লাশটি কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ ইউনিয়নের কাচিসাইর জনৈক নজরুল মাস্টারের বাড়ির সামনে কালভার্টের নিচে সরকারি খালে ডোবার পানিতে ফেলে আসে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কোম্পানীগঞ্জে একটি শিশুর লাশ পাওয়া গেছে, এমন সংবাদ পেয়ে আমির হোসেন তার পরিবারের লোকজনকে নিয়ে তাদের মনে বিশ্বাস স্থাপন করার উদ্দেশ্যে সেখানে যায়। এছাড়া বিষয়টিকে গুজব বলেও পরিবারের সদস্যদের জানায় সে।’
র্যাবের এই মুখপাত্র বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে ১৪ নভেম্বর লাশ পাওয়ার পর আমির হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে দেবিদ্বার থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। ভিকটিম নিখোঁজ হওয়ার পর সন্ধানের উদ্দেশ্যে এবং লাশ পাওয়ার পর হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার জন্য প্রকৃত হত্যাকারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার পোস্ট করে, যেন তাদের ওপর কারও সন্দেহ না হয়।’
উল্লেখ্য, গত ৭ নভেম্বর বিকেলে কুমিল্লার দেবিদ্বারে ৫ বছরের শিশু ফাহিমা আক্তার নিখোঁজ হয়। এই ঘটনায় শিশু ফাহিমার বাবা আমির হোসেন দেবিদ্বার থানায় গত ১১ নভেম্বর একটি সাধারণ ডায়েরি করে। পরবর্তী সময়ে ১৪ নভেম্বর কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ ইউনিয়নের কাচিসাইর জনৈক নজরুল মাস্টারের বাড়ির সামনে কালভার্টের নিচে ডোবা থেকে ফাহিমার বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মো. আমির হোসেন ভিকটিমের লাশটি তার মেয়ে ফাহিমা আক্তারের বলে শনাক্ত করে।