নাজমুল করিম ফারুক, তিতাস (কুমিল্লা):
জমিদারবাড়ী মানেই অপূর্ব কারুকাজ করা বিশাল ভবন। দেয়ালের প্রতিটি পরতে পরতে সৌন্দর্যের ছোঁয়া, ইতিহাস ও ঐতিহ্যর সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা। অন্যান্য জমিদারবাড়ীর চেয়ে একটু হলেও বাড়তি সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায় কুমিল্লার তিতাস উপজেলার মজিদপুর জমিদারবাড়ীতে। এখানে পাশাপাশি কয়েকটি ভবন রয়েছে- প্রতিটি ভবনই চমৎকার কারুকার্যমণ্ডিত। একত্রে এত ভবন পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে যে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
রাজধানী ঢাকা ও জেলা শহর কুমিল্লা থেকে ৫০ কিলোমিটার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে গৌরীপুর বাস ষ্টেশন থেকে হোমনা-গৌরীপুর সড়কের ১০ কিলোমিটার উত্তরে তিতাস উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন অবস্থিত। কমপ্লেক্স ভবন সংলগ্ন কড়িকান্দি বাজার থেকে ঠিক পশ্চিম দিকে ৫ কিলোমিটার গেলেই চোখে পড়বে কালের সাক্ষী মজিদপুর জমিদার বাড়ী।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইংরেজ আমলের প্রথম দিকে লর্ড কর্ণওয়ালিস জায়গীরদারী প্রথাকে বিলুপ্ত করে জমিদারী প্রথা প্রচলন করেন। কিন্তুু তৎকালীন মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষভাব থাকার কারণে ইংরেজরা হিন্দু বুদ্ধিমান ও তাবেদার শ্রেণীর লোকদেরকে জমিদারী প্রদান করেন। বৃহত্তর দাউদকান্দি মূলতঃ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা বিধায় কোন প্রভাবশালী জমিদার ছিল না। সোনারগাঁয়ের হিন্দু জমিদারদের অধীনেই পরিচালিত হত দাউদকান্দি পরগণা। তবে তিতাসের মজিদপুরে হিন্দু জমিদার বাড়ির নিদর্শন এখনও বিদ্যমান রয়েছে। মোট ১৭ টি অট্টালিকার মধ্যে ৪টি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। জমিদার বাড়ির আশেপাশে ১টি দীঘি এবং ছোট বড় মিলে ২০টি পুকুর রয়েছে। যদিও দীর্ঘদিন যাবৎই জমিদারদের প্রাসাদপম অট্টালিকা সমুহ মুসলমানদের দখলে রয়েছে। বর্তমানে তাদের কোন উত্তরাধিকারীর সন্ধান পাওয়া যায়নি। পাকিস্থান সৃষ্টির পরই হিন্দু জমিদাররা তাদের সবকিছু পরিহার করে ভারতে চলে যান। বর্তমানে সবগুলো ভবনই জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তবে ভবনগুলো বেশ কারুকার্য খচিত এবং বিভিন্ন খুপড়ির অস্তিত খুঁজে পাওয়া যায়। ভবনগুলোর মাঝে সুড়ঙ্গ পথও রয়েছে।
জমিদারী শাসনের শুরুর দিকে মজিদপুর জমিদার বাড়ির প্রথম পুরুষ শ্রী রামলোচন রায় মজিদপুরে এসে বসতি স্থাপন করেন। মেঘনা, তিতাস, হোমনা ও মুরাদনগর পর্যন্ত তাদের জমিদারী ছিল। শ্রী রামলোচন রায়ের তিন পুত্র শ্রী কালীচরন রায়, ব্রজেন্দ্র কুমার রায় এবং শিবচরন রায়। জমিদারী আইন বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত বংশ পরস্পরায় তাদের জমিদারী চলে। শ্রী কালীচরনের পাঁচ ছেলে যথাক্রমে পিয়ারী মোহন রায়, বিহারী মোহন রায়, শশী মোহন রায়, শরৎচন্দ্র রায় এবং মোহিনী মোহন রায়। ব্রজেন্দ্র কুমার রায় এর তিন ছেলেরা হলেন ক্ষিতিষ চন্দ্র রায় যিনি মজিদপুর ইউনিয়নের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন, গিরিশ চন্দ্র রায় এবং শিরিশ চন্দ্র রায়। শিবচরন রায়ের দুই ছেলে হলেন হররাল রায় এবং যোগেশ চন্দ্র রায়। শিরিশ চন্দ্র রায় গর্ভবতী স্ত্রীকে হত্যা করে উম্মাদ হয়ে যান। তাকে জমিদার বাড়ির একটি প্রকোষ্টে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। এ অবস্থাই তার মৃত্যূ হয়। ক্ষিতিশ চন্দ্র রায়ের দুই পুত্র শ্রী নারায়ন চন্দ্র রায় এবং শ্রী দুর্গাচরন রায়। শ্রী দুর্গাচরন রায়ের তিন পুত্রের মধ্যে ক্ষেত্র মোহন রায় তিতাস উপজেলার প্রথম এন্ট্রাস পাশ, প্রথম গ্রাজুয়েট এবং প্রথম আইনজীবি হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। অপর ছেলে কুঞ্জ মোহন রায় মজিদপুর ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। শরৎ চন্দ্র রায়ের ছেলে উপেন্দ্র চন্দ্র রায় তিতাস উপজেলার প্রথম গ্রাজুয়েট ডাক্তার।
রামলোচন ছাড়াও তাদের বংশের আরও যারা জমিদারী করেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রাম সুন্দর রায় এবং রামগতি রায়। এদের মধ্যে রামগতি রায়ের পুত্র নলিনী ভূষণ রায় মজিদপুর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। স্থানীয় লোকজনের সাথে আলাপ করে জমিদার কর্তৃক মুসলমানদের উপর নানাহ অত্যাচার ও জোর জুলুমের কথা জানা যায়। খাজনা, লগ্নি ও মহাজনী সুদের টাকা সময়মত পরিশোধ করতে না পারলে বন্ধকী সম্পত্তি জবর দখল করে নিত এবং নির্যাতন চালাত। মুসলমানরা তাদের বাড়ির নিকট দিয়ে জুতা পায়ে এবং ছাতা মাথায় দিয়ে যেতে পারতো না। মৌটুপি নিবাসী অত্যন্ত তেজস্বী নির্লোভ চরিত্রের ব্যক্তিত্ব হাবিবুর রহমান মাষ্টার ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তাদের অত্যাচার থেকে মুসলমানরা রক্ষা পায় এবং প্রায় ২শ বছর পূর্বে হিন্দু জমিদাররা এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়।
তিতাসের মজিদপুর জমিদার বাড়ীতে গেলে খানিকটা সময়ের জন্য আপনি চলে যেতে পারেন অতীতে। হয়তো চোখের সামনে ভেসে উঠবে, কানে ভেসে আসবে জমিদার বাড়ীর আগের কোলাহল। কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনটা ভালো হয়ে যাবে। তবে সেই সঙ্গে একটু দুঃখবোধও মনের কোণে উঁকি দেবে। কারণ অবহেলায় জমিদারী ঐতিহ্য ক্রমেই ম্লান হতে চলেছে।