তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্কঃ
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় দ্রুত বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সরকারি-বেসরকারি সব সেবাসহ দেশের প্রায় প্রতিটি কর্মকাণ্ডে লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে প্রযুক্তি নির্ভর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ দাঁড়িয়েছে এক অন্য রকম উচ্চতায়।
দেশের মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল ভোগ করছেন। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মসংস্থানসহ এমন কোনো খাত নেই যেখানে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে না।
সব সেবা মিলছে অনলাইনে: এখন আর শুধু বেসরকারি সেবা নয়, সরকারি সব সেবাও মিলছে অনলাইনে। কেনাকাটা থেকে শুরু করে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হতো যে কাজে সেই জমির পর্চাও মিলছে অনলাইনে। জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ই-নামজারি, পাসপোর্টের আবেদন থেকে শুরু করে সবকিছুই মিলছে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা ডিজিটাল সেন্টারগুলোতে। ঢাকার বাইরে তিন হাজার ৮০০ ইউনিয়নে ফাইবার অপটিক্যাল কেবল দিয়ে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হয়েছে। সেখানে তৈরি করা হয়েছে ডিজিটাল সেন্টার। সেখানে ২৭০টিও বেশি সেবা পাওয়া যাচ্ছে।
মোবাইল ফোনে আর্থিক লেনদেন: দেশে এখন ১০ কোটি মানুষ মোবাইল ফোনে আর্থিক লেনদেন করছে। বর্তমানে মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) একাউন্ট প্রায় ১২ কোটি। এরমধ্যে সক্রিয় একাউন্টের সংখ্যা ৫ কোটির বেশি। দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে মানুষ এখন মোবাইল ব্যাংকিং নির্ভর হয়ে উঠেছে।
বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ডেটা সেন্টার এখন দেশে: গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হাইটেক সিটিতে ৭ একর জমির ওপর তৈরি করা হয়েছে জাতীয় তথ্যভাণ্ডার বা জাতীয় ডেটা সেন্টার। এটি ইতোমধ্যে বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তর ডেটা সেন্টারের স্বীকৃতি পেয়েছে। শুধু দেশীয় তথ্যের সুরক্ষা নয়, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন এই তথ্যভাণ্ডার ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছে। শুধু তথ্যের সুরক্ষাই নয়, বছরে সাশ্রয় হচ্ছে ৩৫৩ কোটি টাকা। এটাকেই বলা হচ্ছে, ‘হার্ট অব ডিজিটাল বাংলাদেশ’।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ইত্তেফাককে বলেন, সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকারি-বেসরকারি খাতের তথ্য সংরক্ষণের জন্য বড় পরিসরে ডেটা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা থেকে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল ‘ফোর টিয়ার ন্যাশনাল ডেটা সেন্টার’ স্থাপনের কাজটি করা হয়েছে। জনপ্রশাসনে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কাজের দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ানো, তথ্য সংরক্ষণ ও জনগণের দোরগোড়ায় ডিজিটাল সেবা পৌঁছে দিতেই সরকারের এই উদ্যোগ।
তিনি আরও বলেন, এতে ডিজিটাল কনটেন্টগুলোর সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে জনসেবা উন্নত হবে। প্রকল্পটির মাধ্যমে সরকারের সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সব সরকারি কার্যালয়ের আইসিটি কার্যক্রম সরাসরি যুক্ত থাকবে। দেশে আধুনিক ডিজিটাল কার্যক্রম, সেবা প্রদান ও ই-বিজনেসের মূল ভিত্তি এই ডেটা সেন্টার।
হাইটেক সিটি: ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের সভায় কালিয়াকৈরে ২৩১ একর জমিতে হাইটেক সিটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। পরে আয়তন বাড়িয়ে ৩৫৫ একর করা হয়। পার্কে উচ্চগতির ইন্টারনেট, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ, যোগাযোগের জন্য শাটল ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কম দামে পাওয়া যাচ্ছে নিষ্কণ্টক জমি কিংবা স্পেস। এখানে সরাসরি ১ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় প্রকল্পটি পিপিপি (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) মডেলে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এখানে উৎপাদিত পণ্যে ১০ বছর কর অবকাশসহ থাকছে নানাবিধ সুবিধা। উৎপাদিত সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার পণ্য রফতানিতে উৎপাদকরা পাবেন ১০ শতাংশ প্রণোদনা। এখানে কারখানা স্থাপন করলে ব্যাংক ঋণের সুবিধাও করে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে হাই-টেক পার্কের সংখ্যা ৩৯টি।
ফাইভ-জি যুগে বাংলাদেশ: ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশের বর্ষপূর্তির দিনে ফাইভ-জি যুগে প্রবেশ করল দেশ। ফাইভ-জি প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রাহক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংগস), রোবটিক্স, বিগডাটা, ব্লকচেইন, হিউম্যান টু মেশিন, মেশিন টু মেশিন ইত্যাদি প্রযুক্তি ও ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে ক্রিটিক্যাল মিশন সার্ভিস, স্মার্ট গ্রিড, স্মার্ট সিটি, স্মার্ট হোম, স্মার্ট ফ্যাক্টরি সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে।
এই প্রযুক্তির মাধ্যমে মোবাইল ফোন গ্রাহকরা অধিকতর উন্নত ও গুণগত মানের ভয়েস কল ও দ্রুততর মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারে সক্ষম হবে। চালকবিহীন গাড়ি চালানো যাবে, কারখানায় উৎপাদনশীলতাও বৃদ্ধি করা যাবে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর, বাংলাদেশ সচিবালয়, সংসদ ভবন, সাভারের স্মৃতিসৌধ ও টুঙ্গিপাড়া- এই ৬ জায়গা ফাইভ-জি কভারেজের আওতায় আসছে। পরবর্তীতে ঢাকার ২০০টি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এ সেবা চালু করা হবে। ২০২২ সালের মার্চে বেতার তরঙ্গ বরাদ্দ নিলামে দেওয়ার পর বেসরকারি আরও ৩টি মোবাইল অপারেটর এই প্রযুক্তি চালু করবে। ২০২২ সালের পর টেলিটক ও বিটিসিএলের মাধ্যমে দেশের স্পেশাল ইকোনমিক জোনগুলোতে এই সেবা চালুর প্রস্তুতি চলমান রয়েছে।
মহাকাশে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১: বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে মহাকাশ বিজ্ঞানের যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের ১১ মে বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৪ মিনিট (স্থানীয় সময় বিকেল ৪টা ১৪ মিনিটে) যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয় এই স্যাটেলাইট। এর মধ্য দিয়ে ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশের তালিকায় যোগ হয় বাংলাদেশের নাম। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অর্জনের তালিকায় যুক্ত হয় আরও একটি পালক।
২০২৩ সালের মধ্যেই মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণ করা হবে বলে জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে দুই বছর ধরে নিজেদের কারিগরি সহায়তায় ত্রুটি-বিচ্যুতি ছাড়াই সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সে ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হবে।
ই-কমার্স ও এফ-কমার্স: ই-কমার্স কিংবা এফ-কর্মাসের মাধ্যমে অনলাইনে কেনাকাটার প্রতি বেশ কয়েক বছর ধরেই আগ্রহ বাড়ছে দেশের মানুষের। বিশেষ করে করোনা মহামারিকালীন অনলাইনের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। মাত্র কয়েক বছর আগেও ঈদ শপিং মানেই ছোটবড় বিভিন্ন শপিংমল, বিপণি বিতান ও ফ্যাশন হাউসে ঘুরে ঘুরে পণ্য কেনার ব্যাপার ছিল। কিন্তু ক্রেতাকে এখন আর যানজটে আটকে থেকে, মার্কেটে মার্কেটে ঘুরে ক্লান্ত ও গরমে ঘেমে অস্থির হতে হয় না। পছন্দের পণ্যটিতে ক্লিক করে অর্ডার করলেই পৌঁছে যাচ্ছে ক্রেতার ঘরে। ফলে, এক দিকে যেমন অনলাইন শপিংয়ের পরিধি ও পরিসর সম্প্রসারিত হচ্ছে অন্যদিকে শহরের বড় বড় শপিং কমপ্লেক্সেও পড়ছে তার প্রভাব।
বর্তমানে এফ-কমার্স নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪৮মিলিয়ন ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছেন। তরুণ প্রজন্মের শতকরা ৮০ভাগেরও বেশি এখন ফেসবুকের সঙ্গে যুক্ত। ফলে বড় একটা বাজার তৈরি হয়েছে এই ফেসবুককে কেন্দ্র করে। ফেসবুকে ব্যবসা পরিচালনা করা ই-কমার্সের তুলনায় বেশ সহজ। কারণ, এখানে আলাদা করে ওয়েবসাইট ম্যানেজ করার প্রয়োজন হয় না।
ফ্রিল্যান্সিং: আইসিটি বিভাগের লার্নিং এন্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রামে বসেই ফ্রিল্যান্সাররা উপার্জন করছে শত শত ডলার। ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারে দেশে রোমিটেন্স এখন দিনদিন বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্ট মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার বা ১৫ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। তার আগের মাস জুলাইয়ে এসেছিল ১ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১৫ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা।
প্রবাসীদের সঙ্গে দেশের রেমিটেন্সকে আরও বাড়িয়ে নিতে দেশে থেকেই রেমিট্যান্স যুদ্ধে নেমেছেন লাখ লাখ তরুণ। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করে অনলাইন ট্রান্সফারের মাধ্যমে তারা দেশে আনছেন তাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা। ফলে একদিক থেকে তারা যেমন নিজেদের স্বাবলম্বী করছেন, তেমনি বৃদ্ধি করছেন দেশের রেমিট্যান্স আয়। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে এখন দেশে সাড়ে ৬ লাখ মানুষ ভাগ্যের পরিবর্তন করেছেন। এই খাতে এখন ঘটে চলেছে নীরব বিপ্লব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মোকাবিলায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের চলমান অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিতে দক্ষ মানবসম্পদ, কানেকটিভিটি ও আইসিটি অবকাঠামো উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পখাতে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।
সামনের দিনের চ্যালেঞ্জটাও মোকাবেলায় আর্থিক খাতকে সুরক্ষিত রাখতে মনোযোগ দিতে হবে সাইবার নিরাপত্তায়। সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগের পাশাপাশি তরুণদের নানা উদ্যোগ আর প্রচেষ্টাই পারে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর উন্নত বাংলাদেশ গড়তে।