জাতীয় ডেস্কঃ
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যানের পর বিএনপির নির্বাচিত পাঁচ এমপির শপথ, সংসদে যোগদান ও একজনের শপথ না নেওয়া নিয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের বিতণ্ডা চলছে প্রকাশ্যে। এই ইস্যুতে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্যরা দুই ভাগ হয়ে দুই দিকে অবস্থান নিয়েছেন। তারা নিজেদের পক্ষ ভারী করার চেষ্টা করছেন। একপক্ষ এ নিয়ে আলোচনার জন্য জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা তলবের দাবি জানিয়েছেন। অপরপক্ষ দলীয় সিদ্ধান্তের বিরোধীতাকারীদের সন্দেহের চোখে দেখছেন।
‘নেতাকর্মীরা বিভ্রান্ত’
এ প্রসঙ্গে বুধবার জিয়াউর রহমানের ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীতে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, নির্বাচনের পর দলীয়ভাবে আমরা ফল প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। সংসদকে অনির্বাচিত, অবৈধ সংসদ হিসেবে অভিহিত করেছিলাম। সে কারণে আমরা এই সরকারের অধীনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি নাই। যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন (প্রায় ২১০ জন), তাদের বহিষ্কার করেছিলাম। কিন্তু হুট করে শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়ায় আমাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। এই বিভ্রান্তি দূর করতে হবে। বিভ্রান্তি দূর করার জন্য সকল অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের প্রতিনিধিসহ জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা ডেকে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে আমাদের ভুল-বোঝাবুঝি দূর করতে হবে। তিনি বলেন, গত নির্বাচনের সময় আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তারা জেল খেটেছে, আহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে। এমনকি মৃত্যুবরণ করেছে। হঠাত্ করে এই সংসদে যোগ দেওয়ায় সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে বিএনপির বর্তমান অবস্থান নিয়ে শত শত প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের দিতে হবে।
‘চাপের চেয়ে লোভ ছিল বেশি’
শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে তাঁতি দল আয়োজিত এক আলোচনা সভায় গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বিএনপির এমপিদের শপথ গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারি চাপের চেয়ে লোভ বেশি ছিল। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সংসদে যাব না। কিন্তু সংসদে গেলাম। এখানেই তো বুঝতে হবে আমাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের প্রবণতা আছে। আমরা অবাধ্যকে বাধ্য করতে পারি না। কারণ তাদের দলের প্রতি ও রাজনীতির প্রতি অঙ্গীকার নাই। এই পাঁচ জন অবাধ্য এমপিকে যদি আমরা বাধ্য করতে পারতাম তাহলে আজকে আমাদের দুঃখ থাকত না। এরা কি একটা দিনের জন্য বলেছে যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মুক্ত না হলে সংসদে যাব না? তার মানে তাদের সংসদে যাওয়াটা জরুরি, বেগম জিয়ার মুক্তিটা কিন্তু জরুরি না। গয়েশ্বর আরও বলেন, আমরা কমিটি করি। কিন্তু কেউ সংগঠন করি না। কমিটিতে যখন যুগ্ম-আহ্বায়কের সংখ্যা বেশি এবং সদস্য সচিব থাকে তখনই বুঝতে হবে কেউ কাউকে মানে না। তার মানে অঙ্গীকারের অভাব। সংগঠনের চেয়ে নিজেকে সবাই বড় মাপের দেখতে চায়।
এ প্রসঙ্গে দলের একজন সিনিয়র নেতা ইত্তেফাককে বলেন, দলের একটি অংশ দলের হাইকমান্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে তত্পর হয়ে উঠেছেন। দলের কোন বিষয়ে বা কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিমত থাকলে তা দলীয় ফোরামে আলোচনা না করে যারা প্রকাশ্যে রাজপথে দলের সমালোচনা করেন তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। দলের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে প্রকাশ্য সভা-সমাবেশে রাজপথে কথা বললে নিঃসন্দেহে নেতা-কর্মীরা আহত হন। দলের নেতা-কর্মীরা আমাদের কাছে প্রশ্ন করেন, আজকে যারা বিএনপির এমপিদের শপথ নিয়ে উন্মুক্ত সমাবেশে কথা বলছেন, সমালোচনা করছেন, ক্ষোভ দেখাচ্ছেন, দলের সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন তারা যদি নির্বাচিত হতেন তা হলে তখন কি তাদের শপথ ঠেকানো যেতো? তখন কি তারা দলীয় সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা করতেন? দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতেন?
স্থায়ী কমিটির পদত্যাগ দাবি
এদিকে বিএনপিতে একটি অংশ স্থায়ী কমিটির পদত্যাগ চাচ্ছেন। তারা সরকারের কৌশলের বিপরীতে পাল্টা কর্মকৌশল নিতে ব্যর্থতার জন্য বর্তমান স্থায়ী কমিটির নেতাদের দুষছেন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বলেন, স্থায়ী কমিটির নেতাদের পদত্যাগ করতে হবে। কেবল খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যু নয়, দলের সার্বিক কর্মকান্ডে কৌশল নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত নিতে তারা ব্যর্থ হচ্ছেন। নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অক্ষমতা রয়েছে। এজন্য তাদের পদত্যাগ করা উচিত।
দলের আরেক ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, যারা গুরুত্বপূর্ণ নেতা আছেন, যাদের ওপর দায়িত্ব আন্দোলন পরিচালনা করার, তারা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমদ আযম বলেন, দলের অভ্যন্তরে কথাগুলো না বলে দলীয় ফোরামের বাইরে বলা কোনো ভাবেই শোভনীয় নয়। এই কথাগুলো তারা প্রকাশ্যে না বলে দলের সভায় আলোচনা করতে পারেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির এমপিদের শপথ গ্রহণের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক করার জন্য এক পক্ষের চাপ থাকলেও অপর পক্ষ বৈঠকে বসতে চাচ্ছেন না। দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, পাঁচ এমপির শপথ গ্রহণের পর দলে বিতন্ডা দেখা দিলে গত এক মাসে দুই দফা স্থায়ী কমিটির বৈঠক করার চেষ্টা হলেও তা একটি পক্ষের বিরোধিতায় ভেস্তে গেছে।