খালেদ সাইফুল্লা, স্টাফ রিপোর্টার যমুনা টেলিভিশনঃ
মুরাদনগর বার্তা টোয়েন্টিফোর ডটকমঃ সেই তনু এখানে ঘুমিয়ে আছে। বাড়ি থেকে প্রায় ২০মিনিট পায়ে হেটে যেতে হয় তার কবরের পাশে। রাস্তার পাশে একটি বিল তার মাঝে একটি উচুঁ ডিবিতে শুয়ে আছে ইয়ার হোসেনের বুকের ধন সোহাগী জাহান তনু। আকাশে চাঁদের আলোয় সবুজ মাঠগুলো নরম বিছানার মতো দেখতে। ফুররফুরে বাতাস বইছে। হয়তো সোহাগী এখানে শুয়ে আছে তাই।
হাটতে হাটতে কাঁপা কন্ঠে ইয়ার হোসেন বলছেন, বাবা আমার জেঠি আদর করে আমার মেয়ের নাম রেখেছিল সোহাগী। ছোটবেলা থেকেই সবাই তাকে আদর করতো। আমি আমার মাকে বলতাম মা তোরে আমি বুকের মধ্যে আটকে রাখতে চাই। মেয়েটাকে বুকে টেনে নিতাম। সে বলতো বাবা, আমি তো বড় হয়েছি। তুমি কি পারবে আমাকে সবসময় বুকে রাখতে।
সত্তোর্ধ এক বৃদ্ধ বললেন, ইয়ার হোসেন শহরে চাকুরী করে। মেয়েটা সবার ছোট। গ্রামে আসতো বছরে একবার। সবাই বলতাম এই মেয়ে একদিন অনেক বড় অফিসার হবে। …বলতে বলতে বৃদ্ধ মানুষটির গলা বসে গেল বোবাকান্নায়। চোখ মুছতে মুছতে বলছেন… আল্লাহ তুমি এর বিচার করো।
প্রতিদিন মির্জানগরের পথ ধরে যারা হেটে যাবেন তারা হয়তো ক’দিন পরই ভুলে যাবেন বিলের পরে ওই কবরখানায় শুয়ে আছে নেকড়ের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত এক কিশোরী। বোন তনু তোর চোখের দিকে তাকালে আমার চোখ ছল ছল করে ওঠে। আমার বোনটির বাসায় ফিরতে দেরি হলে আব্বা আমাকে বলতেন যাওতো -ও এখনওতো এলো না। তোর বাবা যখন বলছিলেন তখন আমার চোখে ভেসে উঠে আমার আদরের বোনটির চেহারা। যে এখন দূর বিলেতে। সেদিন সন্ধ্যায় টিউশনি করিয়ে তুই আর বাসায় ফিরিসনি। এরপর থেকে তোর বাবা মা পাগলের মতো ছুটছে। তোর মা এখন প্রতিরাতে তোকে স্বপ্নে দেখে। তুই পুরস্কার আনার জন্য যে দুটো নতুন জামা আনতে বলেছিলি মা সেগুলো নিয়ে এসেছে রূপসাগরের টেইলার দোকান থেকে।
তনু, ফেলানীরা শকুনের ছোবলে ক্ষত বিক্ষত হয়। জাগিয়ে দিয়ে যায় আমাদের অন্তরাত্মাকে। কতক্ষণ– কতদিন…।
বিকেলে ওই বাড়িতে পৌছেই দেখি কান্নায় কথা বলতে পারছিলেন না তনুর মা। শুধুই বিলাপ করছেন… জননীগো… আমি বাসায় গেলে কে থাকবে আমার পাশে। তুই কই গেলিরে মা…। এই মা’কে শান্তনা দেবে কে? কেউ কি পারবে তার প্রিয় সন্তানকে ফিরিয়ে আনতে।
রুবেল এগিয়ে এসে মা’কে থামাতে চাইলো। মাকে জড়িয়ে নিজেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো ছেলেটি। রুবেল বললো, এইতো ক’দিন আগে আমি আপু আম্মু একসাথে ছবি তুলেছি। আপুর বার্থ ডে ছিল। আমরা কত মজা করতাম। আপু খুব আদর করতো আমাকে।
রুবেল যখন কথা বলছিল। পাশে দাড়িয়ে কথাগুলো শুনছিল গ্রামেরই কিছু মহিলা। বলা নেই কওয়া নেই.. তাদের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুজল। আসলে তনু চলে গিয়ে সবার আপন হয়ে রয়ে গেল।
কিছুটা শান্ত হয়ে এলে মা জানালেন, সেই ছোটবেলা থেকে ভিক্টোরিয়ায় অনার্স পড়া পর্যন্ত কত পুরস্কার যে পেয়েছে তনু! ভালো গান গায় তাই সব অনুষ্ঠানে তাকে ডাকতো। কতছাত্র ছিল তার।
মাগরিবের পর গ্রামের মানুষগুলো দলবেধে গেলো কবর জেয়ারত করতে। তারপর সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে নানা জনের নানা কথা শুনলাম। কারো কারো আক্ষেপ এই গ্রামকে আলোকিত করতো মেয়েটি। সবার ভাষায় ক্ষোভ ধিক্কার। কেউ বলছেন অনেক বড় হবে সে- আমরা তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল। একটি দরিদ্র পরিবার গ্রাাম থেকে শহরে এসেছে। নিরাপত্তার চাঁদরে বেড়ে উঠা শহুরে সভ্যতায় সে কি
অসভ্যতা– তা কি জানতো ইয়ার হোসেন। গ্রামের মেয়েরা ক’জনই বা অনার্স পড়তে পারে। তার মাঝে একটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রদীপ হিসেবে জ্বলে উঠছিল তনু। শুধু লেখাপড়াই নয়, মেধা মননে মেলে ধরেছিল সুপ্ত প্রতিভা। কিন্তু থেমে গেছে সব। জীবন সবারই থেমে যায়। কিন্তু কিছু থেমে যাওয়া রয়ে যায় দু:স্বপ্নের মতো। তনুর বাবা বলছিলেন, মেয়েটা একা একা কলেজে যায়। আমি ভয় পেতাম। তনু আমাকে সাহস দিতো। আজ সেই মেয়ে আমার বাসার পাশেই….।
ফেসবুকে বসলেই দেখি হিজাবে ঢাকা তনুর মুখাবয়বের মিষ্ঠি আভা যেন সৌরভ ছড়াচ্ছে। সবাই সবাই সবাই –এ ঘৃণ্য হত্যার বিচার চায়। আসলেই কি সবাই চায়। না এটা আমার আবেগের কথা। সবাই চায় না বলেই তনুরা ক্ষতবিক্ষত হয়ে জমিনের পড়ে পরে থাকে। ঘাতকেরা সবার মাঝেই থাকে। ছদ্মবেশে।
তনু ক’দিন আগে ফেসবুকে লিখেছিল- আমাকে আমার মতো থাকতো দাও… / আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি। সত্যিই যেন তাই। বিলের ধারে শুয়ে আছে মেয়েটি। চিরনিদ্রায় ঘুমোবে তনু।
এদিকে ঝড় বইছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।এ যেন শুস্ক মরুতে লু হাওয়া। মুনাজাত শেষে রাতের চাঁদের আলোয় মানুষের সারি চলছিল বাড়ির দিকে। কবরটির পাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। সত্যিই কি আমরা আমাদের প্রতিটি বোনকে এ সমাজে নিরাপদ চলতে দিচ্ছি। হয়তো এরপর আর আসা হবে না এখানে। তবু প্রার্থনা আল্লাহ ন্যায় বিচার করবেন।
কেউ কেউ ঘটনা ঘোলা করে ফায়দা নিতে চাচ্ছেন।কোথায় খুন হয়েছে তনু, সেটার চাইতে বড় কথা হলো পুরুষত্ব জাহির করতে আসা কোন নেকড়ের সামনে পড়েছিল হরিনীটি। নেকড়েরা সব জায়গায় বাস করে। শুধু শিকার পেলেই রক্তাক্ত করে নখড়াঘাতে।
মৃত্যুর চারদিন আগে তনু লিখেছিল মান্না’দের গানের দুটি কলি… ‘সবাই তো সুখী হতে চায়/.. তবে কেউ সুখী হয় কেউ হয় না।’… হ্যা এটাই সত্যি।