ঢাকা ০৪:০৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভারতে হঠাৎ রাষ্ট্রহীন ১৯ লাখ মানুষ কোথায় যাবে

আন্তর্জাতিক:

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে আসামে ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স (এনআরসি) বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকায় ঠাঁই মিলেছে তিন কোটি ১১ লাখ ২১ হাজার ৪ জনের। আবেদনকারীর মোট সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৩০ লাখ ২৭ হাজার ৬৬১ জন। অর্থাৎ বাদ পড়েছে ১৯ লাখ ছয় হাজার ৬৫৭ জনের নাম।

কার্ত রাষ্ট্রহীন হয়ে যাওয়া এই বাংলাভাষীদের ভবিষ্যত কী হবে, তাদের দায়িত্ব কে নেবে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান, জীবিকার নিশ্চয়তা কীভাবে হবে, এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।

বাদ পড়াদের মধ্যে ১৭ লাখই বাংলাভাষী। এর মধ্যে আবার হিন্দু ১২ আর মুসলিম ৫ লাখ। এনআরসি প্রকাশের পর বাদ পড়াদের মধ্যে হিন্দু বেশি হওয়ায় অস্বস্থিতে পড়েছে দেশটির ক্ষমতাসীর দল বিজেপি। এরইমধ্যে এনআরসিতে সমাধান আসবে জানিয়ে অন্য বিকল্পের ইঙ্গিত দিয়েছে আসাম রাজ্যের অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা।

শনিবার এই তালিকা প্রকাশ ঘিরে আসামে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সকাল থেকে জারি করা ১৪৪ ধারা। মোতায়েন করা হয় ৬০ হাজার পুলিশ সদস্য। তাদের সঙ্গে রাখা হয় ২০ হাজার আধাসামরিক বাহিনী (সিআরপিএফ) সদস্য।

তালিকায় নাম না থাকলেই বিদেশি বলে চিহ্নিত কিংবা বন্দিশিবিরে নেওয়া হবে না বলে ইতোমধ্যে আশ্বস্ত করেছে আসাম রাজ্য সরকার। আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল জানিয়েছেন, যাদের নাম বাদ পড়েছে তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনও কারণ নেই। আগামী ১২০ দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে আবেদন জানাতে পারবেন তারা।

ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এনডিটিভি জানিয়েছে, তালিকা থেকে বাদ পড়াদের অভিযোগ শুনতে গঠন করা হবে এক হাজার ট্রাইব্যুনাল। অবশ্য ইতিমধ্যেই ১০০ ট্রাইব্যুনাল কাজ শুরু করে দিয়েছে। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে আরও ২০০ ট্রাইব্যুনাল কাজ শুরু করে দেবে। কেউ ট্রাইব্যুনালে হেরে গেলে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারেন। কাউকে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হবে না।

গতকাল সকাল ১০টায় অনলাইনে চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি প্রকাশিত হয়। যাদের ইন্টারনেট সংযোগ নেই, তারা সরকার পরিচালিত সেবাকেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের অবস্থা দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। তালিকায় যাদের নাম নেই, তাদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে বলা হয়েছে ১২০ দিনের মধ্যে।

এই বিষয়ে শুনানির জন্য রাজ্যজুড়ে ১ হাজার ট্রাইব্যুনাল গড়ে তোলা হবে বলে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যেই ১০০ ট্রাইব্যুনাল খোলা হয়েছে। আরও ২০০টি ট্রাইব্যুনাল সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই খোলার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে মামলায় হেরে গেলে হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সুযোগও রয়েছে।

নাগরিকপঞ্জিতে বাদ পড়াদের ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করে ভারত থেকে বের করে দেওয়া হতে পারে বলে আলোচনায় বাংলাদেশের ভেতরেও উদ্বেগ রয়েছে। তবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তার সাম্প্রতিক ঢাকা সফরে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘এটা একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’

তবে শনিবার এনআরসি প্রকাশের পর বিজেপির আইনজ্ঞ সেলের সদস্য ও দলের নেতা বিবেক রেড্ডি গতকাল নতুন এক ‘সম্ভাবনার’ কথা বলেছেন। সর্বভারতীয় এক নিউজ চ্যানেলে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এনআরসি নিয়ে যে আশ্বাস দিয়েছেন, সেটাই শেষ কথা বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। ভবিষ্যতে অনেক কিছুই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

উল্লেখ্য, আসামে প্রথম নাগরিকপঞ্জি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫১ সালে। তবে প্রতিবেশী বাংলাদেশে থেকে বহু মানুষ অবৈধভাবে আসামে বসবাস করছে দাবি তুলে কয়েক দশক আগে আসামে ‘বাঙ্গালি খেদাও’ আন্দোলন শুরু হয়।

তার ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কের মধ্যে অবৈধ বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করে তাদের ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে চার বছর আগে আসাম সরকার নতুন নাগরিকপঞ্জি তৈরির কাজ শুরু করে। নাগরিকপঞ্জিতে ঠাঁই পেতে হলে বাসিন্দাদের প্রমাণ করতে হয়, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আগে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে রাজ্যে আবাস গেঁড়েছেন।

গত চার বছর ধরে সেখানকার বাসিন্দাদের নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণের নানা কাগজ-পত্র হাতে এক দরজা থেকে অন্য দরজায় ছুটতে হয়েছে। এরপর ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রথম খসড়া নাগরিকপঞ্জি প্রকাশ করা হয়। সেখানে মাত্র ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষের ঠাঁই হয়। অথচ আবেদন করেছিল ৩ কোটি ২৯ লাখ মানুষ।

তা নিয়ে তীব্র সমালোচনা ও বিক্ষোভ শুরু হলে ওই বছর জুলাই মাসে সংশোধিত খসড়া নাগরিকপঞ্জি প্রকাশ পায়। নতুন তালিকায় দুই কোটি ৮৯ লাখ মানুষের নাম ঠাঁই পেলেও বাদ পড়েন উত্তর-পূর্ব আসামের ৪০ লাখ বাসিন্দা। তা নিয়েও বিতর্কের পর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হল। এতে বাদ পড়াদের সংখ্যা কমে ১৯ লাখে দাঁড়াল।

এই ১৯ লাখ মানুষের ভবিষ্যত কী?

এই প্রশ্ন নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। আসাম সরকার বলেছে, এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিরা এখনই বিদেশি বলে গণ্য হবেন না। বরং তাদের সামনে এখনো নাগরিকত্ব প্রমাণের সুযোগ আছে।

কিন্তু যে পদ্ধতিতে নাগরিকত্ব প্রমাণের কথা বলা হচ্ছে সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এমনিতেও ভারতে বিচার ব্যবস্থা এমনিতেই দীর্ঘমেয়াদী। তার ওপর প্রতিটি আদালতেই সাধ্যের অতিরিক্ত মামলার বোঝা রয়েছে। এ অবস্থায় নাগরিকত্ব প্রমাণের সম্ভাব্য দীর্ঘ এবং জটিল আপিল আবেদন প্রক্রিয়া দেশটির আদালতকে আরো ভারাক্রান্ত করবে।

বাঙালি অনেক হিন্দুর নামও তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। সে ক্ষেত্রেও দেখা যাবে গরিব লোকজনই আসলে বাদ পড়েছেন। দরিদ্র এ মানুষগুলো আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘোরার এবং মামলা লড়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কোথা থেকে পাবে সেটাও বড় প্রশ্ন।

 

আসামের লেখিকা সঙ্গীতা বড়ুয়া পিশারতি বিবিসিকে বলেন, ‘যাদের নাম তালিকায় নেই তারা এরই মধ্যে নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে আতঙ্কিত। তার অন্যতম প্রধান কারণ ফরেইনার্স ট্রাইব্যুনালের অসহযোগিতাপূর্ণ আচরণ। অনেকেই এটা নিয়ে অভিযোগ করছেন। ফলে তাদের ট্রাইব্যুনালে যেতে হবে এটা ভেবেই অনেকে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।’

যাবতীয় আইনি প্রক্রিয়া শেষে যারা বিদেশি বলে ঘোষিত হবেন তাদের নিয়ে কী করবে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার এর আগে বেশ জোর দিয়েই ‘অবৈধ মুসলমান অভিবাসীদের’ বাংলাদেশে বিতাড়নের কথা বলেছিল। কিন্তু প্রতিবেশী বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবেই তাদের গ্রহণ করবে না। যদিও বাংলাদেশ সরকার চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেনি।

নাগরিকপঞ্জিতে বাদ পড়াদের ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করে ভারত থেকে বের করে দেওয়া হতে পারে বলে যে আলোচনা তা নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরেও উদ্বেগ রয়েছে। কারণ ইতোমধ্যেই প্রতিবেশী আরেক দেশ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

বিদেশি ঘোষিত হওয়া লোকজনকে যদি বিতাড়ন করা নাও করা হয় সেক্ষেত্রে তারা নিজেদের সম্পত্তির দখল পাবে কিনা বা একজন নাগরিক যেসব সামাজিক সুবিধা পান সেগুলো পাবেন কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। হতে পারে বন্দিশিবির থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তাদের মৌলিক কিছু সুযোগ সুবিধাসহ কাজ করার অনুমতি দেওয়া হবে। কিন্তু তারা আর ভোট দিতে পারবেন না।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

মুরাদনগরে কৃষক ও উদ্যোক্তাদের দিনব্যাপী কর্মশালা

ভারতে হঠাৎ রাষ্ট্রহীন ১৯ লাখ মানুষ কোথায় যাবে

আপডেট সময় ০৪:৩৫:৪৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩১ অগাস্ট ২০১৯
আন্তর্জাতিক:

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে আসামে ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স (এনআরসি) বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকায় ঠাঁই মিলেছে তিন কোটি ১১ লাখ ২১ হাজার ৪ জনের। আবেদনকারীর মোট সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৩০ লাখ ২৭ হাজার ৬৬১ জন। অর্থাৎ বাদ পড়েছে ১৯ লাখ ছয় হাজার ৬৫৭ জনের নাম।

কার্ত রাষ্ট্রহীন হয়ে যাওয়া এই বাংলাভাষীদের ভবিষ্যত কী হবে, তাদের দায়িত্ব কে নেবে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান, জীবিকার নিশ্চয়তা কীভাবে হবে, এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।

বাদ পড়াদের মধ্যে ১৭ লাখই বাংলাভাষী। এর মধ্যে আবার হিন্দু ১২ আর মুসলিম ৫ লাখ। এনআরসি প্রকাশের পর বাদ পড়াদের মধ্যে হিন্দু বেশি হওয়ায় অস্বস্থিতে পড়েছে দেশটির ক্ষমতাসীর দল বিজেপি। এরইমধ্যে এনআরসিতে সমাধান আসবে জানিয়ে অন্য বিকল্পের ইঙ্গিত দিয়েছে আসাম রাজ্যের অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা।

শনিবার এই তালিকা প্রকাশ ঘিরে আসামে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সকাল থেকে জারি করা ১৪৪ ধারা। মোতায়েন করা হয় ৬০ হাজার পুলিশ সদস্য। তাদের সঙ্গে রাখা হয় ২০ হাজার আধাসামরিক বাহিনী (সিআরপিএফ) সদস্য।

তালিকায় নাম না থাকলেই বিদেশি বলে চিহ্নিত কিংবা বন্দিশিবিরে নেওয়া হবে না বলে ইতোমধ্যে আশ্বস্ত করেছে আসাম রাজ্য সরকার। আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল জানিয়েছেন, যাদের নাম বাদ পড়েছে তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনও কারণ নেই। আগামী ১২০ দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে আবেদন জানাতে পারবেন তারা।

ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এনডিটিভি জানিয়েছে, তালিকা থেকে বাদ পড়াদের অভিযোগ শুনতে গঠন করা হবে এক হাজার ট্রাইব্যুনাল। অবশ্য ইতিমধ্যেই ১০০ ট্রাইব্যুনাল কাজ শুরু করে দিয়েছে। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে আরও ২০০ ট্রাইব্যুনাল কাজ শুরু করে দেবে। কেউ ট্রাইব্যুনালে হেরে গেলে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারেন। কাউকে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হবে না।

গতকাল সকাল ১০টায় অনলাইনে চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি প্রকাশিত হয়। যাদের ইন্টারনেট সংযোগ নেই, তারা সরকার পরিচালিত সেবাকেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের অবস্থা দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। তালিকায় যাদের নাম নেই, তাদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে বলা হয়েছে ১২০ দিনের মধ্যে।

এই বিষয়ে শুনানির জন্য রাজ্যজুড়ে ১ হাজার ট্রাইব্যুনাল গড়ে তোলা হবে বলে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যেই ১০০ ট্রাইব্যুনাল খোলা হয়েছে। আরও ২০০টি ট্রাইব্যুনাল সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই খোলার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে মামলায় হেরে গেলে হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সুযোগও রয়েছে।

নাগরিকপঞ্জিতে বাদ পড়াদের ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করে ভারত থেকে বের করে দেওয়া হতে পারে বলে আলোচনায় বাংলাদেশের ভেতরেও উদ্বেগ রয়েছে। তবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তার সাম্প্রতিক ঢাকা সফরে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘এটা একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’

তবে শনিবার এনআরসি প্রকাশের পর বিজেপির আইনজ্ঞ সেলের সদস্য ও দলের নেতা বিবেক রেড্ডি গতকাল নতুন এক ‘সম্ভাবনার’ কথা বলেছেন। সর্বভারতীয় এক নিউজ চ্যানেলে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এনআরসি নিয়ে যে আশ্বাস দিয়েছেন, সেটাই শেষ কথা বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। ভবিষ্যতে অনেক কিছুই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

উল্লেখ্য, আসামে প্রথম নাগরিকপঞ্জি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫১ সালে। তবে প্রতিবেশী বাংলাদেশে থেকে বহু মানুষ অবৈধভাবে আসামে বসবাস করছে দাবি তুলে কয়েক দশক আগে আসামে ‘বাঙ্গালি খেদাও’ আন্দোলন শুরু হয়।

তার ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কের মধ্যে অবৈধ বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করে তাদের ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে চার বছর আগে আসাম সরকার নতুন নাগরিকপঞ্জি তৈরির কাজ শুরু করে। নাগরিকপঞ্জিতে ঠাঁই পেতে হলে বাসিন্দাদের প্রমাণ করতে হয়, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আগে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে রাজ্যে আবাস গেঁড়েছেন।

গত চার বছর ধরে সেখানকার বাসিন্দাদের নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণের নানা কাগজ-পত্র হাতে এক দরজা থেকে অন্য দরজায় ছুটতে হয়েছে। এরপর ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রথম খসড়া নাগরিকপঞ্জি প্রকাশ করা হয়। সেখানে মাত্র ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষের ঠাঁই হয়। অথচ আবেদন করেছিল ৩ কোটি ২৯ লাখ মানুষ।

তা নিয়ে তীব্র সমালোচনা ও বিক্ষোভ শুরু হলে ওই বছর জুলাই মাসে সংশোধিত খসড়া নাগরিকপঞ্জি প্রকাশ পায়। নতুন তালিকায় দুই কোটি ৮৯ লাখ মানুষের নাম ঠাঁই পেলেও বাদ পড়েন উত্তর-পূর্ব আসামের ৪০ লাখ বাসিন্দা। তা নিয়েও বিতর্কের পর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হল। এতে বাদ পড়াদের সংখ্যা কমে ১৯ লাখে দাঁড়াল।

এই ১৯ লাখ মানুষের ভবিষ্যত কী?

এই প্রশ্ন নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। আসাম সরকার বলেছে, এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিরা এখনই বিদেশি বলে গণ্য হবেন না। বরং তাদের সামনে এখনো নাগরিকত্ব প্রমাণের সুযোগ আছে।

কিন্তু যে পদ্ধতিতে নাগরিকত্ব প্রমাণের কথা বলা হচ্ছে সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এমনিতেও ভারতে বিচার ব্যবস্থা এমনিতেই দীর্ঘমেয়াদী। তার ওপর প্রতিটি আদালতেই সাধ্যের অতিরিক্ত মামলার বোঝা রয়েছে। এ অবস্থায় নাগরিকত্ব প্রমাণের সম্ভাব্য দীর্ঘ এবং জটিল আপিল আবেদন প্রক্রিয়া দেশটির আদালতকে আরো ভারাক্রান্ত করবে।

বাঙালি অনেক হিন্দুর নামও তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। সে ক্ষেত্রেও দেখা যাবে গরিব লোকজনই আসলে বাদ পড়েছেন। দরিদ্র এ মানুষগুলো আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘোরার এবং মামলা লড়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কোথা থেকে পাবে সেটাও বড় প্রশ্ন।

 

আসামের লেখিকা সঙ্গীতা বড়ুয়া পিশারতি বিবিসিকে বলেন, ‘যাদের নাম তালিকায় নেই তারা এরই মধ্যে নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে আতঙ্কিত। তার অন্যতম প্রধান কারণ ফরেইনার্স ট্রাইব্যুনালের অসহযোগিতাপূর্ণ আচরণ। অনেকেই এটা নিয়ে অভিযোগ করছেন। ফলে তাদের ট্রাইব্যুনালে যেতে হবে এটা ভেবেই অনেকে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।’

যাবতীয় আইনি প্রক্রিয়া শেষে যারা বিদেশি বলে ঘোষিত হবেন তাদের নিয়ে কী করবে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার এর আগে বেশ জোর দিয়েই ‘অবৈধ মুসলমান অভিবাসীদের’ বাংলাদেশে বিতাড়নের কথা বলেছিল। কিন্তু প্রতিবেশী বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবেই তাদের গ্রহণ করবে না। যদিও বাংলাদেশ সরকার চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেনি।

নাগরিকপঞ্জিতে বাদ পড়াদের ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করে ভারত থেকে বের করে দেওয়া হতে পারে বলে যে আলোচনা তা নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরেও উদ্বেগ রয়েছে। কারণ ইতোমধ্যেই প্রতিবেশী আরেক দেশ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

বিদেশি ঘোষিত হওয়া লোকজনকে যদি বিতাড়ন করা নাও করা হয় সেক্ষেত্রে তারা নিজেদের সম্পত্তির দখল পাবে কিনা বা একজন নাগরিক যেসব সামাজিক সুবিধা পান সেগুলো পাবেন কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। হতে পারে বন্দিশিবির থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তাদের মৌলিক কিছু সুযোগ সুবিধাসহ কাজ করার অনুমতি দেওয়া হবে। কিন্তু তারা আর ভোট দিতে পারবেন না।