এন এ মুরাদ, মুরাদনগরঃ
সমাজে প্রতিবন্ধীরা অসহায় নয়, নিজে ইচ্ছা করলে করতে পারেন অনেক কিছু। বাঁচতে পারেন সম্মান নিয়ে। এমন একজন জীবন সংগ্রামী মানুষ হলেন কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার পত্রিকা বিক্রেতা প্রতিবন্ধী আব্দুর রহিম(৩৫)। দিন-রাত, রোদ-বৃষ্টি, গরম-শীত, মওসুমী নিম্নচাপসহ সকল প্রাকৃতিক দূর্যোগ উপেক্ষা করে প্রতিদিন কাকডাকা ভোর থেকে শুরু হয় তার জীবনযুদ্ধ। ১৪ বছর ধরে প্রায় ৪০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে খবরের কাগজ বিক্রি করে পরিবারকে অন্নের জোগান দিয়েছেন তিনি। প্রতিদিন ভোরে গাড়ি থেকে পত্রিকা সংগ্রহ করে পৌছেদিতেন বাসা-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্নস্থানে। শুরুতে অনেকে অনেক কটূ কথা শোনলেও সকল বাঁধা-বিপত্তি উপক্ষো করে নিজের মতো করে এগিয়ে গেছেন রহিম।
আব্দুর রহিম মুরাদনগর উপজেলার নহল চৌমহনী গ্রামের সাহেব আলীর ছেলে।
যে বয়সে শিশুরা স্কুল মাঠে খেলা-ধূলা ও দূষ্টামি করে দিন কাটাবার কথা, ঠিক সে সময়ে সংসারের অভাব-অনটনের কারনে পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো জীবন জীবিকার তাগিদে তাকেও করতে হয় কাজের সন্ধান। ১০ বছর বয়সে ঝুঁকিপূর্ণ রড তৈরীর কারখানায় কাজ বেছে নেয় সে। কাজ শুরুর ২ বছরপর কারখানায় একটি র্দূঘটনায় হাড়াতে হয় তার ডান হাত। পরিবারের দারিদ্রতা ও নিজের পঙ্গুত্বের মধ্যেও নিজের ইচ্ছা শক্তিতে পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত লেখা পড়া করেন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও মনের দিক থেকে অদম্য সাহসী রহিম। তার মতো অনেককেই রাস্তার মোড়ে কিংবা বাজারে-বাজারে ভিক্ষা করতে দেখা যায়। কিন্তু রহিম সে পথ বেছে নেয়নি। শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও জীবিকানির্বাহে প্রতিবেশী পেপার বিক্রেতা চাচার হাত ধরে ২০০৬ সালে থেকেই দৈনিকের সাথে জড়িয়ে যায় পত্রিকা বিক্রিতে। একদিন কৃত্রিম হাত লাগানোর একটি সংবাদ পত্রিকায় দেখতে পেয়ে নতুন করে বাচার স্বপ্ন তৈরী হয় আব্দুর রহিমের। পত্রিকা বিক্রির জমানো টাকা দিয়ে লাগিয়ে নেন কৃত্রিম হাত। প্রথমে পাঁয়ে হেঁটে পত্রিকা বিক্রি করলেও কৃত্রিম হাত স্থাপনের পর সাইকেল চালিয়ে প্রতিদিন ৪০ কিলোমিটার রাস্তা ঘুরে উপজেলার বাখরাবাদ গ্যাস ফিল্ড, জাহাপুর জমিদার বাড়ি, আলীরচর কলেজ, বোরারচর ও কলাকান্দি বাজারে পত্রিকা বিক্রি করেন। একজন পঙ্গু মানুষ হিসাবে এই কাজটি করা তার জন্য ছিল কঠিন, তবে সংসারের দারিদ্রতা আর সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়তে দেহের সাথে মানিয়ে নিয়েছিলেন। এ পেশায় অনেকের ভালবাসা আর স্মৃতি জড়িয়ে থাকায় কাজটি কষ্ট মনে হতো না। ২০০৮ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে মা, বাবা, স্ত্রী, ২ মেয়ে, ১ ছেলে নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলছিল তার সংসার।
ঠিক সেই সময়ে সারাবিশ্বে করোনার মহামারীতে শুরু হয় একরকম অস্থিরতা। মানুষ হয়ে পরে গৃহবন্দী। লকডাউনে স্কুল,কলেজ, অফিস আদালত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকা বিক্রি। ঠিক তেমনি রহিমের জীবনের পথ চলাও থমকে যায়। অন্যদের মতোই রহিমের রুজি রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে পরিবার নিয়ে আর্থিক অনটনে পরেন তিনি। শুরু হয় তার জীবনের পিছু টানা। করোনা ভাইরাস প্রদুর্ভাব শুরুর দিকে কিছু সাহায্য সহযোগিতা পেলেও বর্তমানে খুব কষ্টে চরম অনাটনে আছেন।
হাত পেতে নয়, কাজ করে জীবন বদলাতে চান প্রতিবন্ধী আব্দুর রহিম। তাই বিভিন্ন হোটেল, খাবার হোটেল ও দোকানে কাজের সন্ধানে ঘোরে। কিন্তু পঙ্গু হওয়ায় কেউ তাকে কাজ দেয় না। সরকারি বা কোন বিত্তশালীদের সহযোগিতা পেলে শুরু করতেচান নতুন কোন ব্যাবসা।
আব্দুর রহিম বলেন, ‘প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই বলুন না কেন আমার মনে হয় এ পেশাটি একটি সেবামূলক কাজ। এতেই আমার সন্তুষ্টি। এতেই আমি আত্মতৃপ্তি বোধ করি। সংসার ছেড়ে আমাকে প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই খবরের কাগজ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বের হতে হয়। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চাকরিজীবী থেকে শুরু করে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ আমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকেন। সারাদিন কর্মব্যস্ততায় মানুষ যখন হাঁপিয়ে ওঠেন তখন আমার বিলি করা এই পেপার পত্রিকাগুলো পড়ে কিছুটা হলেও তারা স্বস্তিবোধ করেন। সাইকেলের প্যাডেল চাপিয়ে সারা বিশ্বের ঘটে যাওয়া নানান ঘটনার পান্ডুলিপি ঘাড়ে নিয়ে ছুটে যাই পাঠকের কাছে। এখানেই আমার তৃপ্তি। এখানেই আমি সুখ খুঁজে পাই।’
তিনি আরো বলেন, সমাজে বিত্ত-বৈভবের মাঝে জন্ম গ্রহণ না করায় সংসার চালাতে জীবিকা নির্বাহে অর্থ সংগ্রহের জন্য আমাকে এ পেশা বেছে নিতে হয়েছিল। যদিও এখন লকডাউন নেই কিন্তু লকডাউনের কালিমার ছাপ পড়েছে পেপার বিক্রি ব্যবসায়। দৈনিক খবরের কাগজের পাতায় করোনার জীবাণু থাকার ভয়ে অনেকেই পেপার কেনা বাদ দিয়েছেন। আগে যে পরিমান পত্রিকা বিক্রি করতাম, এখন নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। অপরদিকে পত্রিকা এজেন্টরা পাওনা টাকা পরিশোদ করতে চাপ দেয়। পাওনা টাকা পরিশোদ না করা পর্যন্ত নতুন করে পত্রিকা দিতে রাজি হচ্ছেন না! তাই আমার পত্রিকা বিক্রি করা বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকলে খাবো কি বলুন। আমরাও তো মানুষ, ঘরে বউ বাচ্চা আছে সংসার আছে। সরকারি কোন সাহায্য সহযোগিতা পাই না। এ ব্যবসা করে চলা আর সম্ভব হচ্ছে না। তাই সাত সদস্যের পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে কোনো রকম বেঁচে আছি। হাত পেতে খেতে চাইনা। তাই একটি কাজরে খোঁজ করছি।