আজিজুর রহমান রনিঃ
ঘটনা এক।
রিনা আক্তার। কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলা সদর ইউনিয়নের আলীরচর গ্রামের জামাল মিয়ার স্ত্রী। স্বামী বিদেশে থাকেন তাই ঘরের কাজের পাশাপাশি জায়গা-জমির দেখাশুনাও করতে হয় রিনাকেই। গত কয়েক মাস আগে একটি জমি রেজিষ্ট্রি করেছেন এক দলিল লিখকের মাধ্যমে। জমির শ্রেণি ছিল নাল। যার মূল্য সরকারি তালিকা মতে ২০ লক্ষ টাকা। কিন্তু দলিল লিখক জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে নালকে বানিয়েছেন ডোবা। আর মূল্য দেখিয়েছেন ২০ লক্ষের পরিবর্তে ২ লক্ষ। দলিল লিখকের এই অভিনব প্রতারণায় সরকার রাজস্ব হারিয়েছেন ১ লক্ষ ৬২ হাজার টাকা। তবে রিনা আক্তার যখন বুঝতে পারলেন দলিল সঠিক হয়নি, তখনই উপজেলা সাব-রেজিষ্ট্রারকে বিষয়টি জানান তিনি। দলিল সঠিক করে করে দেওয়া হবে বলে আজ নয়তো কাল এই বলে সময় দেয়া হচ্ছে রিনাকে। কিন্তু ভুক্তভোগী রিনা সকাল বিকেল সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে ঘুরেও দলিল সঠিক করতে পারছেন না।
ঘটনা দুই।
উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের বাখরাবাদ মৌজায় ১০৪৫ দাগ চাঁন্দিনা ভিটি। সরকারি নির্ধারিত তালিকায় আছে ওই ভিটি প্রতি শতকের মূল্য ৪২ লক্ষ ৩৪ হাজার ৯’শ ৫২ টাকা। সম্প্রতি ওই মৌজায় এক দলিল লিখকের মাধ্যমে জমি রেজিষ্ট্রি হয় মোট ৫.৯৪ পয়েন্ট। যার সরকারি তালিকা অনুযায়ী মূল্য দাঁড়ায় ২ কোটি ৫১ লক্ষ ৫৫ হাজার ৬’শ ১৪ টাকা। ওই টাকার ৯% সরকারি কোষাগারে ব্যাংক চালানের মাধ্যমে জমা দিতে হয় বিধিমোতাবেক। সরকারি কোষাগারে জমা হওয়ার কথাছিল ২২ লক্ষ ৬৪ হাজার ৫টাকা। মোটা অংঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য ভুয়া কাগজ বানিয়ে চান্দিনা ভিটিকে শ্রেণি পরিবর্তন করে বাড়ি দেখিয়েও জমির মূল্য তালিকা অনুযায়ী আসার কথা ৩২ লক্ষ ৩৪হাজার ৬’শ ৯৩ টাকা। এখানে সরকারের রাজস্ব পাওয়ার কথা ছিল ২লক্ষ ৯১ হাজার ১’শ ২২ টাকা। তবে এখানেও অফিসের লোকদের সহায়তা নিয়ে দলিলের মূল্য দেখানো হয় ২৬ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা। যা থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয় ২লক্ষ ৪০হাজার ৩’শ টাকা। যার কারণে এখানেও সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হয় ৫০ হাজার ৮’শ ২২টাকা। ওই মৌজার এই দলিল রেজিষ্ট্রি বাবদ সরকার মোট রাজস্ব হারায় ২৩ লক্ষ ১৪ হাজার ৮’শ ২৭ টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের গত ৭মার্চ মাসে মুরাদনগর সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে রেজিষ্ট্রিকৃত ২২০৫, ২২০৬ ও ২২০৭ নং দলিলে ওই রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা ঘটে। আর এই জমির দলিলগুলোর লেখক বর্তমান মুরাদগর সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসের দলিল লিখক সমিতির সভাপতি শাজাহান মুন্সি (সনদ নং-১৭)।
জানা গেছে, দলিলের দাতা রামচন্দ্রপুর গ্রামের মৃত ফজলুর রহমানের ছেলে শরিফ উদ্দিন জমি বিক্রির টাকা ব্যাংকে জমা করতে গেলে, টাকার পরিমান ১০ লক্ষ টাকার বেশি হওয়ায়, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ টাকার উৎস জানতে চায়। ফলে শরিফ টাকা উৎসের প্রমান দেখাতে রেজিষ্ট্রিকৃত দলিলের নকল সংগ্রহ করেন। এই নকল ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে দিলে, তারা দলিলের মূল্যের সাথে শরিফের জমাকৃত টাকার মিল না পাওয়ায় শরিফ বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।
পরে শরিফ দলিলে মূল্য চুরির অভিযোগ এনে দলিল লিখক শাজাহান মোক্তারের বিরুদ্ধে সাব-রেজিষ্ট্রারের বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। তবে অভিযোগ করেও কোন সুফল না পেয়ে শরিফ এই প্রতিবেদককে বিষয়টি জানান। শরিফের অভিযোগের আলোকে সরেজমিনে গিয়ে তদন্ত করলে মুরাদনগর উপজেলার সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসের কালো বিড়ালটি থলে থেকে বেরিয়ে আসে।
সরেজমিনে রামচন্দ্রপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তসিলদার আনোয়ার হোসেনের কাছে গিয়ে বাখরাবাদ মৌজার ১০৪৫ দাগের জমির শ্রেণি জানতে চাইলে, সে অনায়াসে বলে এই জমি চাঁন্দিনা ভিটি। তার কাছে ডকুমেন্ট চাইলে তিনি আর এসর বই বের করে দেখান।
দলিল গ্রহীতা রামচন্দ্রপুর গ্রামের আবু হানিফের ছেলে দিন মোহাম্মদের সাথে জমির সঠিক মূল্য নিয়ে কথা হলে তিনি বলেন, শাজাহান মোক্তারের কথায় কাজে ঠিক নেই। জমির দলিল যেভাবে রেজিষ্ট্রি করার কথা ছিল সেভাবে করেনি সে। পরে অনেক দেন-দরবার করার পর ১লক্ষ টাকা আমাদেরকে ফেরত দিয়ে ক্ষমা চান সে। অনেকেই বলেন, তিনি অনেক ক্ষমতা রেখে চলেন, তাই বিষয়টি নিয়ে আর বাড়া-বাড়ি করিনি।
জানা গেছে, মুরাদনগর সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে গড়ে মাসে ১২’শ দলিল হয়। গত ১৮ মাসে শাজাহান মোক্তার ৮০% দলিল বিভিন্ন সিন্ডেকেটের মাধ্যমে বাকিয়ে নেন। সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসের অসাধু কর্মচারীদের যোগসাজসে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে সরকারের মোটা অংঙ্কের রাজস্ব আত্মসাত করে কোটিপতি দলিল লেখক হিসাবে সবার কাছে এক নামে পরিচত। এলাকাজুড়ে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, শাজাহান মোক্তারের পক্ষে সব কিছুই সম্ভব। সামন্য একজন দলিল লেখক হয়ে বড় মেয়েকে লন্ডন, ছেলে ও জামাতাকে পাঠিয়েছেন ইতালি। আর দেশে থাকা ছোট ছেলে বছরে ভ্রমন করছেন এশিয়ার কয়েকটি দেশ।
নাম প্রকাশ না শর্তে অন্তত ২০ জন দলিল লিখত জানান, শাজাহান ক্ষমতাশীন দলের ছত্রছায়ায় থেকে একক আদিপত্য বিস্তার করে রেখেছেন এই রেজিষ্ট্রি অফিসে। বিভিন্ন এলাকার দালাল নিয়োগ করে রেখেছেন। ওই দালালদের মাধ্যমে এলাকা থেকে দলিলের কাজ সংগ্রহ করেন। দলিল লিখক সমিতির সভাপতি ও ক্ষমতাশীন দলের অনুগত হওয়ায় তাঁর ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না।
ওই দলিল লেখকরা আরো জানায়, শাজাহানের বাসা সদরে হওয়ায় সে সব দলিল লিখকদের সাথে বসে দলিলের কাজ করেন না। নিজ বাসাকেই অফিস বানিয়েছেন। গত বিএনপি সরকার ক্ষমতাকালীন সময়ে শাজাহান মোক্তারকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জাল দলিল ও ষ্ট্রাম্পের সাথে হাতেনাতে ধরে জেল হাজতে প্রেরণ করেন। দীর্ঘদিন জেলখেটে আসলেও তার দলিল লিখক সনদ বহাল থাকায় এখনো নানান প্রকার অনিয়ম করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন এবং এখনো ওই জালিয়াতি মামলায় মাসে মাসে হাজিরা দিচ্ছেন।
সূত্র জানায়, ভূমি কর্মকর্তা জাকির হোসেনের কাছে রানীমূহুরী গ্রমের এক মহিলা শাজাহান মোক্তারের নামে জাল দলিল দেওয়ার অভিযোগ দায়ের করলে ভূমি কর্মকর্তা উভয়কে তাঁর অফিসে ডাকেন। কথা বলার এক পর্যায়ে শাজাহান মোক্তার ওই মহিলার সাথে খারাপ আচরণ করলে, মহিলা ওই কর্মকর্তার উপস্থিতিতেই মোক্তারকে জুতা পেটা করেন। এই বিরতকর পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে ভূমি কর্মকর্তা জাকির হোসেন উভয়কে তার কক্ষ থেকে বের করে দেন।
শাজাহান মোক্তার সুরে সুরে বলেন, ‘আমি শাহাজাদা, আমার কর্মচারীরা হচ্ছে হারামযাদা। তারা করেছে ভুল, তাই আমি দিব সে ভুলের মাসুল।’ তিনি আরো বলেন, ‘আর যদি করেন প্রশ্ন দিবনা উত্তর। পারলে দেন লেইক্ষা আমার কাছে আছে মন্তর।’
মুরাদনগর সাব-রেজিষ্ট্রার আনিছুর রহমান বলেন, শাজাহান মোক্তারের দলিলে সরকারের রাজস্ব ফাঁকির প্রমান মিলেছে। সরকার তার লিখা দলিল থেকে যে রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে তা আদায় করার চেষ্টা চলছে। তার বিরোদ্ধে কোন শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? এমন প্রশ্নে সাব-রেজিষ্ট্রার বলেন, আমি অনেক চাপের মুখে আছি তাই কোন ব্যবস্থা নিতে পারছি না।
জেলা রেজিষ্ট্রার শাহাবুদ্দিন তালুকদার বলেন, দলিল লিখক শাজাহানের বিরোদ্ধে আমাকে কেউ জানায়নি। লিখিত ভাবে জানালে ব্যবস্থা নিব।