আজিজুর রহমান রনি, বিশেষ প্রতিনিধিঃ
বন্ধুকে গাছে বেঁধে জন্মদিন পালন। বিড়ি ফুঁকে ছবি ফেসবুকে আপলোড করা। একসঙ্গে আড্ডা। এরপর রাস্তায় স্কুল ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত, মাদক সেবন ও মানুষকে হয়রানি। ঠোকনো অজুহাতে লোকজনকে মারধর, চুরি-ছিনতাই, এমনকি মাদক সেবন ও ব্যবসা।
কুমিল্লার মুরাদনগরে এভাবে নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে একশ্রেণির কিশোর ও তরুণ। আর তাদের পেছনে আছেন ‘বড় ভাইয়েরা’।
মুরাদনগর সদর, নবীপুর পশ্চিম এবং পূর্ব ইউনিয়নে পুরো এলাকায় কতটি কিশোর দল বা অপরাধী চক্র আছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই থানা-পুলিশের কাছে। গত এক মাসের বেশি সময় ধরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে ৬টি ‘কিশোর গ্যাং’এর সন্ধান পাওয়া গেছে।
গত রবিবার (০২-০৭-২২) সকালে গোমতী বেরি বাঁধের কাছে একাদশ শ্রেণির অমি নামের এক শিক্ষার্থীর উপর ঝাপিয়ে পড়েছে গ্যাংয়ের সদস্যরা। হাত-পা বেঁধে জন্মদিন পালনের নামে তাকে করেছে নির্যাতন। নির্যাতন করার পর রাফসান, সাঈদুল ও ইয়াসিন ভূইয়াকে দেখা গেছে প্রফুল্ল মনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছে। তাছাড়া নাফিজ তার নিজস্ব ফেসবুক আইডিতে নিজের বিড়ি ফোকার ছবি পোস্ট করেছে একাদিক। গত কয়েক মাস যাবৎ এধরণের ঘনা ঘটছে অহরহ।
তাছাড়া গত মাসের ২৮ তারিখ দিনদুপুরে কে বা কাহারা মাষ্টার পাড়ার বাসিন্দা অধ্যক্ষ নূরুল হক স্যারের বাসার জানালা কেটে ঘরে ঢুকে ৬০ হাজার টাকা ও ৬ ভরি স্বর্ণ অলংঙ্কার নিয়ে যায়। একই দিনে সন্ধ্যায় আইডিয়াল স্কুলের সামনে থেকে একটি অটোরিক্সা চুরি হয়। গত মঙ্গলবার বিকেলে মিষ্টি পট্টির ইয়ার খানের মিষ্টি দোকানের পাশে কাথা কাটাকাটির এক পর্যয়ে ডিম বিক্রেতা কালা মিয়ার ছেলে রহিমকে ছয় বন্ধু মিলে বেধরক কিল ঘুষি মেরে রক্তাক্ত জখম করে। গত পনের দিন আগে মিষ্টি পট্টির আমিরের দোকানের কর্মচারি রাজিব দোকানে আসার পথে রাস্তায় ব্যাক্লমেইল করে মোবাইলটি নিয়ে যায় কয়েকজন কিশোর।
তাড়াছা গোমতি নদীর বেরিবাদ ঘেঁষে অবস্থিত নূরুনন্নাহার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি কিশোরদের দখলে থাকে বেরিবাদের রাস্তা। সুযোগ পেলেই মেয়েদের করছে উত্ত্যক্ত, নিয়ে যাচ্ছে মোবাইল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দোকান মালিক বলেন, মুচি বাড়ি থেকে বাংলামদ খেয়ে এসে মাতলামি করতে দেখা যায়। কোন পথচারিকে একলা পেলে ছুরি দিয়ে গাই দেয়ার ভয় দেখিয়ে তারা মোবাইল নিয়ে যায়। আর গার্লস স্কুলের মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা তাদের নিত্য দিনের কাজ।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, প্রতিটি কিশোর দল বা বাহিনীর পেছনে আছেন এলাকার একশ্রেণির ‘বড় ভাই’। তাঁরা কোনো না কোনোভাবে স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত। এই বড় ভাইদের অধীনে থাকে ১৫ থেকে ২২ বছর বয়সী কিশোর ও তরুণরা। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মানুষকে হয়রানি, মারধর বা রাজনৈতিক মিছিলে এসব কিশোর তরুণকে ব্যবহার করেন তাঁরা।
মুরাদনগর থানার ওসি আবুল হাসিমের ভাষ্য, ‘বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে মুরাদনগর সদরে প্রচুর মানুষ ভাড়া থাকেন। তাছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় অন্য এলাকার লোকজনও এখানে আসেন। অনেক সময় অপরাধীরা অপরাধ করে অন্য জায়গায় চলে যায়। এসব অপরাধীকে ধরতে আমরা তৎপর।’
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব কিশোরের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের। কারও বাবা রিকশা চালান, কারও বাবা চা বিক্রি করেন, আবার কারও মা-বাবা গৃহকর্মীর কাজ করেন। কিশোরদের কেউ স্কুল থেকে ঝরে পড়া, কেউ বা স্কুলেই যায়নি। আবার কেউ কেউ নবম-দশম শ্রেণীতে পড়ছে।
নবীপুর পশ্চিম ইউনিয়নের নিমাইকান্দি এলাকার একটি অপরাধী চক্রের প্রধান এক কিশোরের (১৫) বাবার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি একটি রাজমেস্ত্রীর দোকানের সহকারী। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে ভালো ছিল। নবম শ্রেণীতে পড়তো। করোনা আসার পর স্কুল বন্ধ দেয়। স্কুল খোলার পর সে আর স্কুলে যায়নি। পরে সঙ্গদোষে বখাটেপনার দিকে চলে যায়।’