মো: মোশাররফ হোসেন মনির:
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার তিন ফসলি জমির বুক চিরে ছুটছে ট্রাক্টরের পর ট্রাক্টর। লক্ষ্য ফসলি জমি থেকে কাটা মাটি ইট ভাটায় নিয়ে আসা। সামান্য অদূরেই চলছে বিস্তীর্ণ ফসলি জমির মাঝ খান থেকে অত্যাধুনিক ভেকু মেশিন দিয়ে জমির মাটি কাটার কর্মযজ্ঞ। সে মাটি সংগ্রহে ব্যস্ত অসংখ্য ইটভাটার শ্রমিক। যেই জমির উপরিভাগে ধান বোনা হতো সে জমিতে এখন বিশাল আকারের র্গত। এভাবেই মুরাদনগর উপজেলার বিপুল পরিমাণ ফসলি জমির মাটি যাচ্ছে ইটভাটার পেটে। এতে করে ওই জমিগুলো যেমন উর্বরতা হারাচ্ছে তেমনি ধ্বংস হচ্ছে এসব ফসলি জমি।
এদিকে উপজেলার ৫৪টি ইটভাটা জমির টপ সযয়েল কেটে নিলেও রহস্য জনক কারনে এসব দেখেও না দেখার ভান করছে স্থানীয় প্রশাসন। অভিযোগ রয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়সহ সকল সেক্টরকে ম্যানেজ করেই ইটভাটা মালিক সিন্ডিকেট মিলে উর্বর ফসলি জমির মাটি কেটে নিচ্ছে। এতে সচেতন মহলে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, এভাবে মাটি কেটে নিলে ফসলি জমির উর্বরতা শক্তি কমে গিয়ে ফসল উৎপাদনে বিপর্যয় দেখা দিবে।
পতিত জমি, খাল, বিল, নদ-নদী, হাওর-বাঁওড় বা চরাঞ্চল থেকে মাটি কেটে নেওয়া যাবে না ইট তৈরীর জন্য। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩-এর ৫ নম্বর ধারায় উল্লেখ থাকলে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না মুরাদনগর উপজেলায়। দিনের পর দিন স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উপজেলায় গড়ে ওঠা ৫৪টি ইটভাটায় মুরাদনগর সদর, যাত্রাপুর, বাখরাবাদ, পায়র, সুবিলারচর, রানীমুহূরী, শুশুন্ডা, দারোরা, বড় আলীরচর, সোনাপুর, চাপিতলা, কোড়াখাল, বাবুটিপাড়া, ছালিয়াকান্দি, বোরারচর, চন্দনাইল, রোয়াচালা, শ্রীকাইল বিলের কৃষিজমি, গোচারণ ভূমি, জলাশয় ও গোমতী নদের পাড়ের গুঞ্জুর, ত্রিশ, দক্ষিণ ত্রিশ ও ধামঘর এলাকার মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে ইট ভাটায়। আইন লঙ্ঘনকারী ইটভাটার বিরুদ্ধে কোন প্রকার ব্যবস্থা না নেওয়ায় বাস্তবে ফসলি জমি ধ্বংসের মহোৎসব চলছে এই উপজেলায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার প্রায় ৫৪টি ইট ভাটার মালিক ফসলি জমি থেকে অবাদে মাটি কেটে ইট তৈরির কাজে ব্যবহার করছে। এর মধ্যে নবীপুর পূর্ব ইউনিয়নের বখরনগর মৌজায় ১৭টি ইট ভাটা থাকায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পরছে সেই ইউনিয়নে। কৃষি জমি থেকে মাটি খননের কারণে দিন দিন কমে যাচ্ছে কৃষি জমি। ঠিক তেমনি নষ্ট হচ্ছে জমির উর্বর শক্তি আর জীববৈচিত্র।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিবছর একেকটি ভাটায় প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ ইট উৎপাদন (পোড়ানো) হয়। উপজেলায় থাকা ৪৬টি ইটভাটার মাটি কাটার জন্য ফসলি জমির মাঠে কাজ করছে ২৭ টি খননযন্ত্র ও প্রায় ৩২২টি ট্রাক্টর। প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাটিভর্তি ট্রাক্টরগুলো ফসলি জমির উপর দিয়ে জোর পূর্বক রাস্তা তৈরি করে চলাচল করছে। এতে ধুলাবালুতে দুই পাশের জমির ফসল বিনষ্ট হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে কিছু বলতেও পারছেন না নিরীহ কৃষকেরা। আবার কেউ কেউ লিখিত অভিযোগ দিয়েও পাচ্ছে না প্রতিকার।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ২২টি ইউনিয়নে নদী-নালা খাল-বিল বাদে প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার ২৮ হেক্টর ফসলী জমি রয়েছে। শ্রেণী ভেদে প্রায় সকল জমিতেই সারা বছর কোনো না কোনো ধরণের ফসল চাষ করে কৃষকরা। এক শ্রেণীর কৃষকরা ভাটা মালিকদের লোভে পড়ে প্রতি গাড়ি (ট্রাক্টর) মাটি পাঁচ’শ থেকে ছয়’শ টাকায় বিক্রয় করছেন। যে কারণে ওইসব জমিতে না হচ্ছে ধান না হচ্ছে মাছের চাষ। জমি গুলো দেখে মনে হচ্ছে এ যেন উম্মুক্ত জলাশয়। নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে নির্বিচারে আবাদি কৃষি জমি থেকে মাটি খনন করায় দিনদিন কমে যাচ্ছে ফসলী জমি। অন্য দিকে উর্বর শক্তি কমে গিয়ে ফসল উৎপাদনে হ্রাস পাচ্ছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা পাভেল খাঁন পাপ্পু জানান, কৃষি জমি থেকে মাটি কেটে গর্ত করার কারণে ফসলী জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়। মাটির উর্বর শক্তি কমে যাওয়ার কারণে এই জমিতে আর তেমন ফলন হয় না। এক পর্যায়ে এই জমিগুলোতে ফসল কম হওয়ার কারণে চাষিদেরও আগ্রহ কমে যায়। এই ধরনের কর্মকান্ডে বন্ধ করতে না পারলে আগামীতে উৎপাদনে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে।
মাটি কাটা সিন্ডিকেটের সদস্য শাকিল, আলা, আমির হোসেন বলেন, আমরা কৃষকদেরকে ন্যায্য মূল্য দিয়েই তাদের জমির মাটি ক্রয় করি। কাউকে জোর জবরদস্তি করা হয় না। তাছাড়াা সব সেক্টর ম্যানেজ করেই আমরা মাটি ক্রয় বিক্রয়ের কাজ করতে হয়।
এ বিষয়ে মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুস সামাদ বলেন, কোন মাটি সিন্ডিকেট কিংবা ভাটা মালিকের সাথে আমার পরিচয় নেই। প্রশাসনের সঙ্গে তাদের যোগশাজসের কথাটি সঠিক নয়। মাটি কাটার বিষয়ে আমরা কোনভাবেই কোন ধরনের সম্মতি দেই না। এসব মাটি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আমরা প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করছি। সামনের দিকেও তা অব্যাহত থাকবে।