মুরাদনগর বার্তা ডেস্কঃ
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প-২’ এর আওতায় “জমি আছে ঘর নাই” প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে উপজেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে। উপজেলার ২২টি ইউনিয়নের মধ্যে যাদের জমি আছে ঘর নাই, এমন অসহায় দুস্থ ও প্রতিবন্ধী ব্যাক্তিদের তালিকা করে ওই সকল ৩৭৬টি পরিবারকে সরকারি ভাবে বিনামূল্যে ঘর দেওয়ার কথা থাকলেও উপকারভোগীদের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে সরকারি এ ঘর দেওয়া হয়েছে বিত্তশালীদের। অপর দিকে নিম্ম মানের সামগ্রী দিয়ে এসব ঘর নির্মাণ করায় বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে ঘরগুলো। নিয়মনীতি উপেক্ষা করে ঘর বন্টন করায় এ আশ্রয়ন প্রকল্পের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হতদরিদ্ররা। তবে অর্থের বিনিময়ের বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনের কাছে সুনির্দিষ্টি লিখিত অভিযোগ করেও কোন প্রকার ব্যাবস্থা গ্রহন না হওয়ায় উপজেলার সাধারন মানুষের মাঝে ক্ষোভ তৈরী হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা অনিয়মের অভিযোগ করে জানায়, প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় আশ্রয়হীন দুস্থ ও অসহায় পরিবারের মাঝে বিনামূল্যে ঘর প্রদান প্রকল্পে অর্থের বিনিময়ে ঘর দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ঘর থেকে গড়ে ২০ থেকে ৫০ হাজার করে নেওয়া টাকা পকেটে ভরেছে স্ব স্ব স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার, চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টরা। আর যারা টাকা দিতে পেরেছে তাদের নামের তালিকা নিয়েছে জনপ্রতিনিধিরা। অপর দিকে ঘর তৈরীর মালামাল উপকারভোগীদের বাড়ী নেওয়ার জন্য পরিবহন ভাড়া বাবদ ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ ছাড়া আগামী প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ অনেকের কাছ থেকে অগ্রিম ১০ হাজার করে টাকা নেওয়ারও অভিযোগ ওঠেছে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, উপজেলার সদর ইউনিয়নের ঘোড়াশাল গ্রামের মোতাহার হোসেন কালা মিয়া ইউপি সদস্য আব্দুল মালেকের দোকান বাকীর ২০ হাজার ও নগদ ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে এ ঘর পেয়েছে। কাজিয়াতল গ্রামের ইউপি সদস্য জহিরুল ইসলামের ভাই ও মৃত সামছুল হকের ছেলে সুমন ঢাকায় নিজ মালিকানাধীন বাড়ীতে বসবাস করলেও তিনি ঘর পেয়েছে। একই এলাকার মৃত মজলু মিয়ার স্ত্রী নূরজাহান বেগমের বরাদ্ধ ঘর স্থানীয় মহিলা মেম্বার শাহানাজ বেগমের বাড়িতে নির্মাণ করা হয়েছে। পূর্বধইর পূব ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মামুনুর রশিদের ভাই ও দৈলবাড়ি গ্রামের মৃত আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে ইউছুফের নামে ঘর নেওয়া হয়েছে। আকুবপুর ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ও মেটেংঘর গ্রামের জুয়েল রানা কোটিপতি হয়েও ঘর পেয়েছে। পূর্বধইর গ্রামের মৃত সাহেব আলীর ছেলে রশিদ মিয়া স্থানীয় ইউপি সদস্য মোশাররফ হোসেনকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ঘর পেয়েছে। পরে আরো ২০ হাজার টাকা মেম্বারকে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, র্মীজাপুর গ্রামের মৃত মঙ্গল মিয়ার ছেলে খোরশেদ মিয়ার পুরাতন ঘরটি স্থানীয় মেম্বারকে দিয়ে পেয়েছে নতুন ঘর। মীর্জাপুর গ্রামের পুকুর পাড় এলাকার মৃত সুন্দর আলীর ছেলে রবিউল ও রামচন্দ্রপুর উত্তর ইউনিয়নের সোনাকান্দা গ্রামের মৃত কুদ্দুছ মিয়ার ছেলে শাহ আলম চট্টগ্রামে বসবাস করলেও ছোট ভাই উমরের বাড়ীতে ঘর নির্মাণ করে বিক্রি করে দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনুচ্ছুক একজন উপকারভোগী বলেন, আমাকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা দামের একটি ঘর দেওয়ার কথা বলে দুই বারে বিশ হাজার করে ৪০ হাজার টাকা নিয়েছে। পরে আরো ১০ হাজার টাকা চাইলে ৮ হাজার টাকা দেই। যাচাই করার জন্য স্যারেরা আসলে তাদেরকে খানা খাইয়ে আরো এক হাজার টাকাও দিতে হয়েছে। আর ঘর নির্মানের মালামাল চার ধাপে আমাদের বাড়িতে পৌঁছানোর জন্য প্রতিবার এক হাজার টাকা করে চার হাজার টাকা নেয়।
দারোরা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ও কাজিয়াতল গ্রামের জহিরুল ইসলাম তার ভাই ঘর পাওয়ার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ভাই সুমন ঢাকায় একটি গর্মেন্টেসে চাকুরি করেন। সে স্ত্রী সন্তান নিয়ে ঢাকাতে থাকেন। তার অর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় সে গ্রামের বাড়িতে কোন ঘর নির্মান করতে পারেনি। তাই তাকে সরকারি ঘর বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে।
পূর্বধইর পশ্চিম ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মামুনুর রশিদ তার ভাই ঘর পাওয়ার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, হাতের সব আগুল এক সমান হয়না। আমরা সব ভাই আলাদা ভাবে থাকি। এই ভাই বিয়ে না করলেও সে মাকে নিয়ে থাকে। সে একটি দোকানে কর্মচারি হিসেবে কাজ করে।
উপজেলার সদর ইউনিয়নের ও ঘোড়াশাল গ্রামের ইউপি সদস্য আব্দুল মালেক তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, আমি ঘর দেওয়ার মালিক না, আমি নাম দিয়েছি। অফিসাররা মোতাহার হোসেন ওরফে কালা মিয়ার নাম বাছাই করেছে।
মুরাদনগর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা অব্দুল হাই খান অভিযোগ পাওয়া ঘর গুলোর বিষয়ে তদন্ত করা হয়েছে স্বীকার করে জানান, মেম্বারের আত্মীয় স্বজন গরীব হলে কী তারা ঘর পাবে না! ইউপি সদস্যদের সাথে স্থানীয় ভাবে মত-বিরোধ থাকায় এমন অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিতু মরিয়ম জানান, নিম্ম মানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে তা সত্য নয়। তবে বিভিন্ন ইউনিয়নে কিছু অনিয়ম হয়েছে। অনেক ভুক্তভোগী লিখিত অভিযোগ করেছে, বিষয়টি সময় স্বাপেক্ষ। তদন্ত করা হচ্ছে।