মো: মোশাররফ হোসেন মনিরঃ
কুমিল্লা মুরাদনগর উপজেলার সংগ্রামী পাচঁ জয়িতার সফল হওয়ার পিছনে রয়েছে অনেক দুঃখ কষ্টের কাহিনী। কেউ অর্থনীতিতে, শিক্ষা ও চাকুরী, জননী নারী, নির্যাতন ও সমাজ উন্নায়নের ক্ষেত্রে নিজেকে স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন। উপজেলায় নির্বাাচিত পাচঁ জয়িতাদের মধ্যে দুই জন জেলা প্রর্যায়ে শেষ্ঠ হয়েও বিভাগীয় পর্যায়ে ১০ জনের মধ্যে একজন হয়েছেন।
অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী পারুল আক্তার
অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার নবীপুর পূর্ব ইউনিয়নের বাখরনগর গ্রামের কাউছার আলমের স্ত্রী পারুল আক্তার। সে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত হয়ে বিভাগীয় পর্যায়েও ১০ জনের মধ্যে একজন হয়েছে। পারুল আক্তার জানান, অনের বাড়িতে জিয়ের কাজ করে তিন সন্তানসহ পাচঁ জনের সংসার চালাতে খুব হিমশিম পেতে হতো। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে পারতাম না। এমকি না খেয়ে কাটাতে হযেছে দিনের পর দিন। তখন আমি নার্সারী প্রশিক্ষণ দিয়ে ২০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে নার্সারী কাজ করে সংসার চালাতে শুরু করি। পাশাপাশি এলাকার দুঃস্থ লোকদের প্রশিক্ষণ দেই। এতে করেই আস্তে আস্তে আমার অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়। বর্তমানে আমার নার্সারীতে ১০ জন লোক কাজ করে। এখন আমার মাসি আয় ৫০/৬০ হাজার টাকা। সংসারে আর কোন প্রকার সমস্যা নেই। এখন আমি স্বামী সংসার নিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জন করেছি।
সফল জননী নারী তাহেরা বেগম
সফল জননী নারী উপজেলা সদর ইউনিয়নের ধনিরামপুর গ্রামের ও উপজেলার আপামর জনগনের শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক মৃত বদির উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী তাহেরা বেগম। তিনি বলেন, নাবালক এক ছেলে ও তিন মেয়ে সন্তানের জন্মের পর তার স্বামীর মৃত্যু হয়। ২০০১ সারের ৩০ ডিসেম্বর এক শত ৫০ টাকা আমার হাতে দিয়ে বলেন ”ওদের খরচ দিও”। চলে গেলের মুরাদনগরে অনুষ্ঠিত স্কাউটসের কোর্সে। ঐ প্রোগ্রাম চলাকালীনই তার মৃত্যু হয়। এর পর থেকেই শুরু হলো সন্তানদের নিয়ে পথ চলা। এ সময় নেমে আশে কষ্টের অমানিশা। একজন দৃঢ় চেতা নারী হিসেবে সামান্য সম্পদ নিয়ে শুরু করি সন্তানদের গড়ে তোলার সংগ্রাম। সন্তানরা প্রত্যেকেই মেধাবী ও আগ্রহী থাকায় সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করি। স্বামী খুব গাছ প্রেমি হওয়ায় তার লাগানো বাগানের নারিকেল, পেয়ারা, কাঁটাল বিক্রি করে ও টিউশনি করে পয়সা জোগাতাম। বর্তমানে বড় মেয়ে মাষ্টার্স ও বি, এড ডিগ্রী নিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকুরি করছে। ছেলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর হিসেবে ঢাকা সেনা নিবাসে কর্মরত, দ্বিতীয় মেয়ে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেনীতে ব্যবস্থাপনায় উত্তীর্ণ হয়ে পাশাপাশি জাতীয় বেসরকারী কলেজ ও হাই স্কুল নিবন্ধনে নিবন্ধিত। আর ছোট মেয়ে তিন বছর বয়সে বাবার মৃত্যু সময থেকে পঞ্চম ও অষ্টম শেণিতে মেধা বৃত্তিসহ এসএসসি ও এইচ এসসিতে অ+ পেয়ে এখন বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি প্রার্থী। আমি শত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে অদম্য ইচ্ছা ও মনোবলের কারনে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে পেরে আমি গর্বিত।
শিক্ষা ও চাকুরীরতে সাফল্য অর্জনকারী রাশিদা আক্তার
শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে সাফর্য অর্জনকারী নারী উপজেলার পাকগাজীপুর গ্রামের মৃত্যু ডাক্তার জয়নাল আবেদীনের স্ত্রী ও যাত্রাপুর একে উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (ইংরেজী) রাশিদা আক্তার। সে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত হয়ে বিভাগীয় পর্যায়েও ১০ জনের মধ্যে একজন হয়েছে। রাশিদা আক্তার জানান, ছাত্র জীবনে বিদ্যালয়ের মেধা তালিকায় ১ম/২য় স্থান অদিকার করি। ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে ডাক্তার হবো। কিন্তু বাবার আর্থিক অসচ্ছলত তার কারনে ৮ম শ্রেনীতে উত্তীর্ন হওয়ার পরই আমি বাল্যবিবাহে আবদ্ধ হই। স্বামী ছিলেন একজন পল্লী চিকিৎসক। স্বামীর সংসারে কোন অভাব অনটন ও কলহ না থাকায়। তিনি আমার পড়ালেখার প্রতি খুবই আগ্রহ থাকায় স্কুলে ভর্তি হয়ে এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে ১ম স্থান অর্জন করি। তার পরই জন্ম হয় প্রথম সন্তান (ছেলে)। তারপর এইচএসসি পাশের পর জন্ম হয় ২য় ছেলে সন্তান। পরে বিএসএস পাশ করি। সন্তানদের লালন পালন ও সংসার গুছিয়ে ডিগ্রী পাশ করতে আমার সীমাহিন কষ্ট করতে হয়েছে। ডিগ্রী পাশ করার ৩ বছরের পর স্বামী কিডনী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পরই শুরু হয় স্বামী হারা জীবনের সাফল্য বিনির্মাণ প্রতিযোগিতার প্রতিজ্ঞা। তখন আমার বয়স ছিল ২৩। তখনই শুরু হয় আর্থিক অনটন এবং নিরাপত্তার অভাব। এমতাবস্থায় পরিবারের পক্ষ থেকে চাপ সৃষ্টি হয় ২য় বিবাহের জন্য। সেই প্রস্তাবে আমি একমত পোষন না করে ৬ বছরের বড় সন্তান ও ৪ বছরের সন্তনকে নিয়ে স্বামীর বাড়িতে অবস্থান করি। কিন্তু জীবিকা নির্বাহের জন্য একটি এনজিওতে যোগদান করি। এর ৬/৭ মাস পর উপজেলার যাত্রাপুর একে উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকুরি পাই। এখনও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করছি। বর্তমানে বড় ছেলে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার (ফ্যাশান ডিজাইন) শেষে একটি কোম্পানীতে চাকুরী করছে। ২য় ছেলে এমএসসিতে অধ্যায়ন করছে। সন্তানরা ও আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ও মেধা অন্মেষণে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে প্রথম স্থানসহ পৃুরস্কার অর্জন করেছি। আমাকে অনুসরন করে সমাজে অনেক মেয়ে/নারীরা সচেতন হয়ে সফলতা অর্জন করেছে। এবং বিদ্যালয়ে ও সমাজে বাল্যবিবাহ রোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করছি।
সমাজ উন্নয়নের অসামন্য অবদান রেখেছেন পারুল আক্তার
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন উপজেলার নবীপুর পূর্ব ইউনিয়নের বাখরনগর গ্রামের সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী পারুল আক্তার। পারুল আক্তার জানান, এসএসসি পাশ করার পরই তার বাবা এক বেকর ছেলের কাছে তাকে বিয়ে দেয়। স্বামী কোন কাজ না করায় নির্যাতন করত। ১ ছেলে ১ মেয়ে জন্ম গ্রহনের পর স্বামী সংসার না করার সিদ্ধান্ত নিলে সন্তানদের নিয়ে অনেক কষ্টে কোন রকম সংসার চালাতে হতো আমার। শত প্রতিকৌলতার মাঝেও এলাকার উন্নয়নের কথা চিন্তা করে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করি। অদম্য পরিশ্রম করে প্রতিরোধ করছি বাল্যবিবাহ, যৌতুক কিংবা নারী নির্যাতন। বিভিন্ন ধরনের সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। সময় দিতে থাকি অসহায় মানুষদের কল্যাণের জন্য। এলাকার কারো কোন বিপদ-আপদ ও কোন প্রকার সামাজিক সমস্যা দেখা দিলে তাদের পাশে গিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই। শিশুদের স্কুলে ভর্তি, উপবৃত্তি, শিশুদেও টিকা দান, শিশু জন্ম নিবন্ধন সহায়তাসহ ব্রাকের সহযোগিতায় গর্ভবতী মহিলাদের চেকাপ ও বিনামূল্যে ডেলিভারী করাই। মহিলাদের উন্নয়নের চিন্তা করে পল্লী সমাজ মহিলা উন্নয়ন সমিতি নামে একটি মহিলা সমিতি তৈরী করি। এবং ৪০ জন সদস্যকে যুব উন্নয়নের মধ্য দিয়ে এমব্রডারী ও সেলাই কাজের প্রশিক্ষন ব্যবস্থা গ্রহন করি। এবং উৎসাহ ও স্বপ্ন দেখিয়েছি শতশত কিশোরী মেয়েকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যেমে কাজ করছেন স্বপ্না আক্তার
নির্যাতনের বিভিষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যেমে কাজ করছেন উপজেলার নবীপুর পূর্ব ইউনিয়নের বাখরনগর গ্রামের শাহ আলমের মেয়ে স্বপ্না আক্তার। স্বপ্না আক্তার জানান, স্বামী কোন কাজ না করে শুধু তার বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনতে বলত। কিন্তুু বাবার আর্থিক অবস্থা মোটামোটি ভাল থাকলেও সৎ মা থাকায় টাকা না দেওয়া ও আমাকে দেখা শুনা না করায় স্বামী, শ্বশুর ও শ্বাশুরি নির্যাতন করতো। স্বামী আরো তিনটি বিয়ে করে ও পরকীয়া প্রেমও ছিল। রাতে ঠিকমত বাড়েিত আসতনা। তা নিয়ে কোন কথা হলেই শুরু হতো শারিরিক ও মানসিক নির্যাতন। পরে স্বামী সংসার না করার সিদ্ধান্ত নেলে বাবার বাড়ি চলে আসি। কিন্তু সৎ মা আশ্রয় না দিলে চাচার বাড়েিত আশ্রয় নেই। এবং ব্র্র্যাকে মাধ্যমে দেনমোহর ও ভরন পোষনের জন্য দুই লক্ষ টাকা পেয়ে বাচার স্বপ্ন নিয়ে সংসারের অভাব মোচনের জন্য নতুন উদ্যোমে এক খন্ড জমি ক্রয়, কাপড় ও সেলাই মেশিন ক্রয় করে সেলাই কাজ শুরু করে সফল হয়েছি। আমার দোকানে অনেক মহিলা কাজ করে ও সেলাইয়ের কাজে উৎসাহ দেখে অনেকে এ কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছে।