ঢাকা ১১:০২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুরাদনগর উপজেলায় নির্বাচিত চার জয়িতার সফল হওয়ার গল্প…

মো: হাবীবুর রহমান, বিশেষ প্রতিনিধিঃ

কুমিল্লা মুরাদনগর উপজেলার সংগ্রামী চার জয়িতার সফল হওয়ার পিছনে রয়েছে অনেক দুঃখ কষ্টের কাহিনী। কেউ অর্থনীতিতে, জননী নারী, সমাজ উন্নায়নের ক্ষেত্রে নিজেকে স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন।

নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যেমে কাজ করছেন রিনা আক্তার

উপজেলার নবীপুর পূর্ব ইউনিয়নের নগরপাড় গ্রামের আব্দুস ছামাদ ভুইয়ার মেয়ে রিনা আক্তার। সে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত হয়ে বিভাগীয় পর্যায়েও ১০ জনের মধ্যে একজন হয়েছে। রিনা আক্তার জানান, ৮ম শ্রেনী পাশ করার পরই তার বাবা এক বেকর ছেলের কাছে তাকে বিয়ে দেয়। স্বামী কোন কাজ না করে শুধু তার বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনতে বলত। কিন্তুু রিনার বাবার টাকা দেওয়ার সামর্থ না থাকায় স্বামী, শ্বশুর ও শ্বাশুরি নির্যাতন করতো। নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য বাবার বাড়ি থেকে কিছু টাকা ঋণ এনে স্বামীকে বিদেশে পাঠায়। সেখানে ৩ মাস থাকার পর অসুস্থ্য হয়ে স্বামী বিদেশ থেকে দেশে চলে আসে। স্বামীর ঋণের টাকা পরিশোধ করার জন্য রিনা দিশেহারা হয়ে ঢাকায় বিউটিশিয়ানের প্রশিক্ষণ নেয়। প্রশিক্ষণ শেষে স্বামীর সাথে আলোচনা করেই বিউটি পারলার দেওয়ার জন্য একটি দোকান ভাড়া নেয়। তখন মানুষের প্ররোচনায় স্বামী তাকে সন্দেহ করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে স্বামী তার বিউটি পারলারের দোকানটি ভেঙ্গে দেয়। পরবর্তীতে সে রিনার সাথে সংসার না করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে সালীশ হওয়ার পর স্বামী বিষপানের মাধ্যমে আত্মহত্যা করে। এ ঘটনায় শ্বশুর তার বিরুদ্ধে মামলা দিলে কিছুদিন জেল খাটার পর রিনা জামিনে মুক্ত হয়ে আসে। ঐ সময় সে দুই বছরের মেয়েকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে। বাচার স্বপ্ন নিয়ে সংসারের অভাব মোচনের জন্য নতুন উদ্যোমে বিউটিশিয়ানের কাজ শুরু করে সফল হয়েছি। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে বর্তমানে নতুন উদ্যামে কাজ শুরু করে সফলতার সাথে মাসে ৫০ হাজার টাকা আয় করছি। আমার দোকানে ৮ জন মহিলা বিউটিশিয়ানের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে।

সফল জননী নারী সাজিয়া বেগম

সফল জননী নারী উপজেলার নবীপুর পশ্চিম ইউনিয়নের পৈয়াপাথর গ্রামের মৃত আব্দুর রশিদ মিয়ার স্ত্রী সাজিয়া বেগম। তিনি বলেন, দুই মেয়ে ও এক ছেলের জন্মের পর তার স্বামীর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর স্বামীর ভিটেমাটি না থাকা ও সংসার চালানোর মতো কিছুই না থাকায় বাবার বাড়ী চলে আসি। বাবার বাড়ীতে এসেও ভাইদের অবহেলার স্বীকার হই। স্বামীর মৃত্যুর পর দারিদ্রতা ভাইদের উপেক্ষা  আর অবহেলার সঙ্গে লড়াই করা শুরু করে। ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে রাস্তায় মাটি কাটার কাজ শুরু করি। শত প্রতিকুরতা ও দারিদ্র্যের সাথে  আমি আমার সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। বর্তমানে বড় মেয়ে বি.এ, ছোট মেয়ে ৭ম শ্রেণী ও একমাত্র ছেলে এইচ.এস.সিতে পড়াশুনা করছে। পড়াশুনার পাশাপাশি বড় মেয়ে টিউশনিও করেছে। আমার সন্তানদের পড়ালেখা ভালোভাবে চালানোর জন্য চেষ্টা করছি। সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে সমাজে মানুষের উন্নয়নের কাজ করার আশা করছি। আমি শত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে অদম্য ইচ্ছা ও মনোবলের কারনে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে পেরে আমি গর্বিত।

অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী রাশেদা বেগম

অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার ধামঘর ইউনিয়নের পরমতলা গ্রামের খালেদ হোসেন মুন্সীর স্ত্রী রাশেদা বেগম। রাশেদা বেগম জানান, তার স্বামী বিদেশে গিয়েও তেমন কিছু উন্নতি করতে না পারায় সংসার চালাতে খুব হিমশিম পেতে হতো। ছেলে মেয়েদের দুই বেলা খাওয়ানোর মতো আয় হতো না। তখন আমি সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে সেলাই কাজ করে সংসার চালাতে শুরু করি। পাশাপাশি এলাকার দুঃস্থ মহিলাদের সেলাই প্রশিক্ষণ দেই। এতে করেই আস্তে আস্তে আমার অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়। এরই মধ্যে বড় ছেলে বি.এ, বড় মেয়ে এইচ.এস.সি ও ছোট মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে লেখা-পড়া করছে। বর্তমানে আমার আর কোন প্রকার সমস্যা নেই। এখন আমি স্বামী সংসার নিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জন করেছি।

সমাজ উন্নয়নের অসামন্য অবদান রেখেছেন সুফিয়া বেগম

সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন উপজেলার নবীপুর পশ্চিম ইউনিয়নের উত্তর ত্রিশ গ্রামের গ্রাম পুলিশ খোরশেদ আলমের স্ত্রী সুফিয়া বেগম। সুফিয়া বেগম জানান, স্বামী গ্রাম পুলিশের চাকুরী করে ২ ছেলে ৩ মেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে কোন রকম সংসার চালাতে হতো আমার। শত প্রতিকৌলতার মাঝেও এলাকার মহিলাদের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে ৫০ জন নারী সদস্য নিয়ে পল্লী সমাজ  মহিলা উন্নয়ন সমিতি প্রতিষ্ঠা করি। সেই সমিতির ৪০ জন সদস্যদেরকে যুব উন্নয়ন অফিস হতে সরকারি ভাবে এমব্রডারী ও সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহন করি। নারী সমিতির সাথে বিভিন্ন ধরনের সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে সময় দিতে থাকি অসহায় মানুষদের কল্যাণের জন্য। এলাকার কারো কোন বিপদ-আপদ ও কোন প্রকার সামাজিক সমস্যা দেখা দিলে তাদের পাশে গিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই। অদম্য পরিশ্রম করে প্রতিরোধ করছি বাল্যবিবাহ, যৌতুক কিংবা নারী নির্যাতন।  উৎসাহ ও স্বপ্ন দেখিয়েছি শতশত কিশোরী মেয়েকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির ১৭ বছর পর বিজয় দিবস উদযাপন

মুরাদনগর উপজেলায় নির্বাচিত চার জয়িতার সফল হওয়ার গল্প…

আপডেট সময় ০২:৪৪:০০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ জুলাই ২০১৭

মো: হাবীবুর রহমান, বিশেষ প্রতিনিধিঃ

কুমিল্লা মুরাদনগর উপজেলার সংগ্রামী চার জয়িতার সফল হওয়ার পিছনে রয়েছে অনেক দুঃখ কষ্টের কাহিনী। কেউ অর্থনীতিতে, জননী নারী, সমাজ উন্নায়নের ক্ষেত্রে নিজেকে স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন।

নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যেমে কাজ করছেন রিনা আক্তার

উপজেলার নবীপুর পূর্ব ইউনিয়নের নগরপাড় গ্রামের আব্দুস ছামাদ ভুইয়ার মেয়ে রিনা আক্তার। সে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত হয়ে বিভাগীয় পর্যায়েও ১০ জনের মধ্যে একজন হয়েছে। রিনা আক্তার জানান, ৮ম শ্রেনী পাশ করার পরই তার বাবা এক বেকর ছেলের কাছে তাকে বিয়ে দেয়। স্বামী কোন কাজ না করে শুধু তার বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনতে বলত। কিন্তুু রিনার বাবার টাকা দেওয়ার সামর্থ না থাকায় স্বামী, শ্বশুর ও শ্বাশুরি নির্যাতন করতো। নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য বাবার বাড়ি থেকে কিছু টাকা ঋণ এনে স্বামীকে বিদেশে পাঠায়। সেখানে ৩ মাস থাকার পর অসুস্থ্য হয়ে স্বামী বিদেশ থেকে দেশে চলে আসে। স্বামীর ঋণের টাকা পরিশোধ করার জন্য রিনা দিশেহারা হয়ে ঢাকায় বিউটিশিয়ানের প্রশিক্ষণ নেয়। প্রশিক্ষণ শেষে স্বামীর সাথে আলোচনা করেই বিউটি পারলার দেওয়ার জন্য একটি দোকান ভাড়া নেয়। তখন মানুষের প্ররোচনায় স্বামী তাকে সন্দেহ করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে স্বামী তার বিউটি পারলারের দোকানটি ভেঙ্গে দেয়। পরবর্তীতে সে রিনার সাথে সংসার না করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে সালীশ হওয়ার পর স্বামী বিষপানের মাধ্যমে আত্মহত্যা করে। এ ঘটনায় শ্বশুর তার বিরুদ্ধে মামলা দিলে কিছুদিন জেল খাটার পর রিনা জামিনে মুক্ত হয়ে আসে। ঐ সময় সে দুই বছরের মেয়েকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে। বাচার স্বপ্ন নিয়ে সংসারের অভাব মোচনের জন্য নতুন উদ্যোমে বিউটিশিয়ানের কাজ শুরু করে সফল হয়েছি। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে বর্তমানে নতুন উদ্যামে কাজ শুরু করে সফলতার সাথে মাসে ৫০ হাজার টাকা আয় করছি। আমার দোকানে ৮ জন মহিলা বিউটিশিয়ানের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে।

সফল জননী নারী সাজিয়া বেগম

সফল জননী নারী উপজেলার নবীপুর পশ্চিম ইউনিয়নের পৈয়াপাথর গ্রামের মৃত আব্দুর রশিদ মিয়ার স্ত্রী সাজিয়া বেগম। তিনি বলেন, দুই মেয়ে ও এক ছেলের জন্মের পর তার স্বামীর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর স্বামীর ভিটেমাটি না থাকা ও সংসার চালানোর মতো কিছুই না থাকায় বাবার বাড়ী চলে আসি। বাবার বাড়ীতে এসেও ভাইদের অবহেলার স্বীকার হই। স্বামীর মৃত্যুর পর দারিদ্রতা ভাইদের উপেক্ষা  আর অবহেলার সঙ্গে লড়াই করা শুরু করে। ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে রাস্তায় মাটি কাটার কাজ শুরু করি। শত প্রতিকুরতা ও দারিদ্র্যের সাথে  আমি আমার সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। বর্তমানে বড় মেয়ে বি.এ, ছোট মেয়ে ৭ম শ্রেণী ও একমাত্র ছেলে এইচ.এস.সিতে পড়াশুনা করছে। পড়াশুনার পাশাপাশি বড় মেয়ে টিউশনিও করেছে। আমার সন্তানদের পড়ালেখা ভালোভাবে চালানোর জন্য চেষ্টা করছি। সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে সমাজে মানুষের উন্নয়নের কাজ করার আশা করছি। আমি শত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে অদম্য ইচ্ছা ও মনোবলের কারনে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে পেরে আমি গর্বিত।

অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী রাশেদা বেগম

অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার ধামঘর ইউনিয়নের পরমতলা গ্রামের খালেদ হোসেন মুন্সীর স্ত্রী রাশেদা বেগম। রাশেদা বেগম জানান, তার স্বামী বিদেশে গিয়েও তেমন কিছু উন্নতি করতে না পারায় সংসার চালাতে খুব হিমশিম পেতে হতো। ছেলে মেয়েদের দুই বেলা খাওয়ানোর মতো আয় হতো না। তখন আমি সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে সেলাই কাজ করে সংসার চালাতে শুরু করি। পাশাপাশি এলাকার দুঃস্থ মহিলাদের সেলাই প্রশিক্ষণ দেই। এতে করেই আস্তে আস্তে আমার অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়। এরই মধ্যে বড় ছেলে বি.এ, বড় মেয়ে এইচ.এস.সি ও ছোট মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে লেখা-পড়া করছে। বর্তমানে আমার আর কোন প্রকার সমস্যা নেই। এখন আমি স্বামী সংসার নিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জন করেছি।

সমাজ উন্নয়নের অসামন্য অবদান রেখেছেন সুফিয়া বেগম

সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন উপজেলার নবীপুর পশ্চিম ইউনিয়নের উত্তর ত্রিশ গ্রামের গ্রাম পুলিশ খোরশেদ আলমের স্ত্রী সুফিয়া বেগম। সুফিয়া বেগম জানান, স্বামী গ্রাম পুলিশের চাকুরী করে ২ ছেলে ৩ মেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে কোন রকম সংসার চালাতে হতো আমার। শত প্রতিকৌলতার মাঝেও এলাকার মহিলাদের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে ৫০ জন নারী সদস্য নিয়ে পল্লী সমাজ  মহিলা উন্নয়ন সমিতি প্রতিষ্ঠা করি। সেই সমিতির ৪০ জন সদস্যদেরকে যুব উন্নয়ন অফিস হতে সরকারি ভাবে এমব্রডারী ও সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহন করি। নারী সমিতির সাথে বিভিন্ন ধরনের সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে সময় দিতে থাকি অসহায় মানুষদের কল্যাণের জন্য। এলাকার কারো কোন বিপদ-আপদ ও কোন প্রকার সামাজিক সমস্যা দেখা দিলে তাদের পাশে গিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই। অদম্য পরিশ্রম করে প্রতিরোধ করছি বাল্যবিবাহ, যৌতুক কিংবা নারী নির্যাতন।  উৎসাহ ও স্বপ্ন দেখিয়েছি শতশত কিশোরী মেয়েকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের।