জাতীয় ডেস্কঃ
‘রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে ভালোভাবে নির্বাচন করা কমিশনের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে। আমরা চাই আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অধিক অংশগ্রহণমূলক হবে। ’
রোববার (১৩ মার্চ) নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) আয়োজিত শিক্ষাবিদদের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল এ কথা বলেন। সংলাপে ৩০ জন শিক্ষাবিদকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও অংশ নেন ১৩ জন।
সিইসি বলেন, ‘নির্বাচনে দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা লাগবে। প্রথম দিকে বলেছি, ভালো ইলেকশন করাটা পুরোপুরি নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে না। স্টেক হোল্ডার যারা আছেন, তারাও যদি সমভাবে না আসে, রাজনৈতিক আবহ অনুকূল না হয়, দলগুলোর মধ্যে যদি মোটামুটি সমঝোতা না থাকে, পক্ষগুলো যদি বিবাদমান হয়ে যায় তাহলে আমাদের পক্ষে ভালোভাবে নির্বাচন করাটা দুরুহ। ’
তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু রাজনৈতিক দলকে দেখছি তারা কোনোভাবেই নির্বাচন কমিশনকে আস্থায় নিচ্ছে না এবং নির্বাচন থেকে দূরে থাকে তা হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না থাকে, ঘাটতি থাকে, তাহলে সে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতায় কিছুটা ভাটা পড়ে যাবে। আমরা চেষ্টা করবো, আমাদের তরফ থেকে যত্ন করার জন্য। আপনারা সহযোগিতা করবেন। ’
কাজী হাবিবুল আউয়াল রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য শিক্ষাবিদদের লেখালেখি চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘ভালো নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছার অভাব হবে না। সামর্থ্যের অভাবের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়তে পারে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমাদের সংলাপের উদ্দেশ্যে ব্যক্ত করা হয়েছে। এই কমিশন নবগঠিত কমিশন। কমিশনের কাজ হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও লোকাল গর্ভমেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন করা। ’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন কথা বলেছেন। আগের নির্বাচন পুরো অংশগ্রহণমূলক বিভিন্ন কারণে হয়তো হয়নি। সেজন্য আমরা চাই নির্বাচনটা (দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন) যাতে আরো অধিক অংশগ্রহণমূলক হয়। ’
বিকেল তিনটা থেকে দুই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে শিক্ষাবিদদের মধ্যে ড. জাফর ইকবাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহিয়া আখতার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম আনোয়ার হোসাইন, ড. বোরহান উদ্দিন খান, অধ্যাপক এম আবুল কাশেম মজুমদার, ড. সাদেকা হালিম, ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, ড. আখতার হোসেন, অধ্যাপক লায়লুফার ইয়াসমীন, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম মফিজুল ইসলাম, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান। একজন নিজে আসতে না পারলেও তার প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন।
ড. জাফর ইকবাল বলেন, ‘ইভিএম সম্পর্কে বলা হচ্ছে এটা নাকি অনেক হাই লেভেলের টেকনোলজি। আসলে তা না। এটা খুবই লো লেভেলের টেকনোলজি। এখন তো অনেক হাইটেক জিনিসপত্র আছে। আমাদের ভার্সিটির স্টুডেন্টরা ইভিএম নিয়ে প্রজেক্ট করে। ’
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের সাবেক এ অধ্যাপক নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা যত ভালো কাজই করেন, গালি খেতেই হবে। গালি নিয়ে ভাববেন না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে যেন বলতে পারেন, আমি কাজটা ঠিকমতো করতে পেরেছি। এটা গুরুত্বপূর্ণ। ’
প্রবাসীদের সংশ্লিষ্ট দেশেই যেন ভোট দিতে পারে, সে প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ বিদেশে থাকে। তারাও দেশ নিয়ে ভাবে। তারা কীভাবে ভোট দিতে পারে সেটা দেখতে হবে। ’
জাতীয় পরিচয়পত্র প্রসঙ্গে জাফর ইকবাল বলেন, ‘ইদানিং দেখা যাচ্ছে অনেক জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল হচ্ছে। এটার জন্য অনেকে অনেক টাকা খরচ করেও সমাধান পাচ্ছেন না। কমিশন এটা দেখলে ও সমস্যার সমাধান করলে একটা পজিটিভ ইমপ্রেশন পড়বে। ’
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহিয়া আখতার বৈঠকে বলেন, ‘বর্তমান সিস্টেমে আপনারা ভালো নির্বাচন করতে পারবেন না। হয় দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করুন, না হয় আগের কমিশনের মতো দায় নিয়ে বিদায় নেন। আরেকটা কাজ করতে পারেন, সেটা হচ্ছে পদত্যাগ করে সম্মান বাঁচানো। আমরা ১৭ বার সংবিধান সংশোধন করেছি, আরেকবার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে এমন কিছু ক্ষতি হতো না। ’
ইভিএম ব্যবহার নিয়ে তিনি বলেন, এই ভোটিং মেশিন ব্যবহার করা ঠিক হবে না। কারণ আমাদের দেশের ভোটারটা প্রযুক্তি সচেতন নয়। এছাড়া দেশের ইতিহাসে কোনো রাজনৈতিক দল সংলাপে এসেও ইভিএম চায়নি।
তিনি এ সময় নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে জেলা প্রশাসকদের দায়িত্ব না দিয়ে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের নিয়োগ করার পক্ষে মতামত দেন।
এই অধ্যাপক বলেন, নির্বাচনের আগে প্রশাসনিক রদবদল অবশ্যই করতে হবে।
বৈঠকের পর অধ্যাপক সাদেকা হালিম সাংবাদিকদের বলেন, এখনকার সিস্টেমে তো সবাই নিজ নিজ পদে থাকবেন। এমপিরা থাকবেন, মন্ত্রীরা থাকবেন, প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। এটা রেখে আমরা কীভাবে একটা স্বচ্ছ নির্বাচন করতে পারি তা আলোচনা করেছি।
তিনি বলেন, আমাদের পরামর্শ হচ্ছে পরবর্তী নির্বাচন যেন স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক এবং অংশগ্রহণমূলক হয়, নির্বাচনে সহিংসতা যেন না হয়। এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকেকে কীভাবে যুক্ত করা যায় সে কথা আমরা বলেছি।
এছাড়া নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর প্রসঙ্গ তুলে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্ত অনুযায়ী সব পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য পদ পূরণের ব্যবস্থা নিতেও বলেন তিনি।
ড. বোরহান উদ্দিন খান বলেন, আইনে সব আছে। নির্বাচনের ঘড়ির কাটা আপনাদের ঘুরিয়ে দিতে পারে। ভারতের নির্বাচন সুষ্ঠু হলে আপনারা কেন পারবেন না।
অধ্যাপক ড. এম আনোয়ার হোসাইন বলেন, ইসির যথেষ্ট স্বাধীনতা আছে। আইন দ্বারা স্বাধীনতার কোনো কমতি নাই। সেটা প্রয়োগ করতে হবে।
ইভিএম নিয়ে তিনি বলেন, ইভিএম নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নীরিক্ষা হচ্ছে। এটি আরো স্বচ্ছ করার সুযোগ আছে।
নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে ভোটের কিছুদিন আগে থেকে ইসির হাতে ন্যস্ত করতে হবে। সহিংসতা, ভোট জালিয়াতি এড়ানোর জন্য তড়িৎ ব্যবস্থাও নিতে হবে।
প্রবাসীদের বিষয়ে জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য বলেন, পোস্টাল ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোটদানের বিষয়টি আরো কার্যকর করতে হবে। লাখ লাখ মানুষ বিদেশে রয়েছে। আইন অনুযায়ী, প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক অধিকার ভোট দেওয়া। প্রবাসীরা কেন এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
বৈঠকের চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিবসহ সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। নির্বাচন কমিশন আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই সংলাপের আয়োজন করেছে।
আগামী ২২ মার্চ বিশিষ্টজনদের সঙ্গে এবং ৩০ মার্চ গণমাধ্যমের সঙ্গে সংলাপে বসার কথা রয়েছে ইসির। এরপর নারী নেত্রী ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসবে সংস্থাটি।