তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্কঃ
ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যম আর ওটিটি প্ল্যাটফরমের জন্য বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি নতুন একটি নীতিমালার খসড়া প্রকাশ করেছে। প্রস্তাবিত এই নীতিমালা নিয়ে ব্যবহারকারীদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিটিআরসি বলছে, হাইকোর্টের নির্দেশে সামাজিক মাধ্যম এবং অনলাইন প্ল্যাটফরমের কর্মকাণ্ডে শৃঙ্খলা আনার লক্ষ্যে এই নীতিমালার খসড়া তৈরি করা হয়েছে। তবে অনেকেই এই নীতিমালায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এতে আরো সংকুচিত হবে। কারণ এখানে অপরাধের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় আইন প্রয়োগকারীরা এটার অপব্যবহার করতে পারেন।
তবে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, এই নীতিমালা নিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। নীতিমালা বিটিআরসি বা তথ্য মন্ত্রণালয় নিজের উদ্যোগে করেনি। এটা হাইকোর্ট তাদের করতে বলেছে। অপরাধের সংজ্ঞাগুলো অনেক বিস্তৃত, ফলে এর নানা ব্যাখ্যা করে অপপ্রয়োগ হতে পারে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, কোনো একটি নতুন বিষয়কে আইনের আওতায় আনার জন্যই অপরাধের সংজ্ঞাকে বিস্তৃত রাখতে হয়েছে।
নীতিমালায় অনলাইন প্ল্যাটফরমগুলো এবং এর ব্যবহারকারীদের জন্য অনেকগুলো নিয়মকানুন প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য এবং খবর প্রচার করলে বা পোস্ট করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হেয় করে কোনো মন্তব্য বা কটূক্তি করা যাবে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে এমন কিছু করা যাবে না। রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এবং দেশের সঙ্গে বন্ধু দেশগুলোর সম্পর্কের ক্ষতি করতে পারে এমন মন্তব্য, খবর সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করা যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক সুপন এই নীতিমালার খসড়া পর্যালোচনা করে বলেন, অপরাধের সংজ্ঞা অস্পষ্ট রাখা হয়েছে এবং সে কারণে অপপ্রয়োগের সুযোগ থাকছে। বড় যে সমস্যা এখানে (নীতিমালার খসড়ায়) সেটা হচ্ছে, যে কাজগুলোকে অপরাধ হিসেবে বলা হচ্ছে সেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত নয়। এটা উদ্বেগের। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ফৌজাদারি কার্যবিধিতে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে মূলনীতি হচ্ছে, আমাকে কেন কোন কাজ করতে নিষেধ করা হচ্ছে, তা আমাকে বুঝতে হবে। কিন্তু এই নীতিমালায় কিছু বিষয়কে নিষেধ করা হচ্ছে, যেগুলোর পরিধি এতটাই ব্যাপক যে, কোনো কাজ যদি আপাতত অপরাধ না হয়ে থাকে, সেটাকেও নির্বাহী বিভাগ অপরাধ বলে মনে করতে পারে। যেভাবে আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রে অপপ্রয়োগ হতে দেখেছি।
আইনজীবীদেরও অনেকে মনে করেন, নীতিমালার খসড়ায় নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর সংজ্ঞা যেহেতু অস্পষ্ট রাখা হয়েছে, তাই সামাজিক মাধ্যমে কী করা যাবে বা কী করা যাবে না—সেটাও ব্যবহারকারীদের জন্য স্পষ্ট হচ্ছে না। ফলে তাদের মধ্যে প্রতিমুহূর্তে শঙ্কা কাজ করবে। সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা হুমকির মুখে পড়ার সম্ভাবনাও কাজ করছে।
এই প্রবিধানটা যদি শেষ পর্যন্ত অনুমোদিত হয়, তাহলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারও খর্ব হবে। কারণ এই খসড়া প্রবিধানে যেভাবে নিষিদ্ধ বক্তব্য সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, অনেক কিছুই এর আওতায় পড়তে পারে।
হোয়াটস অ্যাপের মতো মেসেজিং সার্ভিস অ্যাপগুলো ব্যবহারের প্রশ্নেও কিছু নিয়মের প্রস্তাব করা হয়েছে নীতিমালার খসড়ায়। যেমন, মেসেজিং অ্যাপগুলোতে এবং সামাজিক মাধ্যমে কারো কোনো বক্তব্য বা পোস্টের কারণে দেশে যদি কোনো খারাপ পরিস্হিতির সৃষ্টি হয়, তখন যে ব্যক্তির পোস্টকে কেন্দ্র করে ঐ পরিস্থিতি তৈরি হবে বা প্রথম যিনি বক্তব্য বা পোস্ট দিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট প্ল্যাটফরমকে ঐ ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ করতে হবে। কাজী মাহফুজুল হক সুপন বলেছেন, এখন এ ধরনের কোনো বিধান না থাকলেও সরকার কারো ব্যাপারে তথ্য চাইলে এসব প্ল্যাটফরম তা অনেক সময় সেটা দিয়ে দেয়।
এ ব্যাপারে মোস্তাফা জব্বার বলেন, কেউ যদি রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজ করেন বা রাষ্ট্রের বিপক্ষে কাজ করেন বা রাষ্ট্রের নীতিমালার বিপক্ষে কাজ করেন, সেটা সংবিধান এবং আইনেও অনুমতি দেয় না। আপনি রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকারক কাজ করবেন, কোনো একটা পোস্ট দিয়ে কোনো জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরি করবেন—আর সেই অপরাধীকে কেউ চিনবে না সেটা হতে পারে না। এটা অপরাধীর পরিচয় উন্মুক্ত করার বিষয়। এই অপরাধীর পরিচয় এই প্ল্যাটফরমগুলো যারা চালায়, তাদের তা বলতে হবে।