ঢাকা ০৪:২৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৭ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও ভাতা পাননি পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ সর্দার

শাহীন মীর্জা, কুমিল্লা থেকেঃ

স্বাধীনতার পর ৪৮ বছর অতিবাহিত হলেও বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ সর্দার এর আর্তনাদ কেউ শুনতে পায়নি। সড়ক দুর্ঘটনায় পা ভেঙ্গে বর্তমানে বিছানায় কাতরাচ্ছেন। জীবিকার প্রয়োজনে এই বৃদ্ধ বয়সেও ঘরে ট্রেচার নিয়ে স্ত্রী প্রবাসে থাকায় ঘরের কাজ কর্ম, রান্নাবান্না করতে হয়।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আদর্শ সদর উপজেলার দৌলতপুর ছায়াবিতান এর প্রায়াত মুসলেম সর্দারের ছেলে ইউসুফ সর্দার দেশমাতৃকার টানে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। দেশকে শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে পিতা মাতাকে রেখে ভারতে গিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে। ২নং সেক্টরের অধীনে ক্যাপ্টেন পাঠানের নেতৃত্বে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাক হানাদার বাহিনীর উপর। তার সহযোদ্ধা হাজীগঞ্জ রামপুরের ৪ জনের মধ্যে নোওহাটার জয়নাল ভাতা ও রেশন পায় অথচ পঙ্গুত্ব বরন করলেও মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ সর্দার সরকারি কোন ভাতাদি পাচ্ছেন না। জানা যায়, জেনারেল এমএজি ওসমানির স্বাক্ষরিত সনদ সহ বিভিন্ন তালিকায় ইউসুফ সর্দারের নাম লিপিবদ্ধ থাকলেও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা থেকে বঞ্চিত। তিনি পঙ্গু হওয়ায় ১ ছেলে, ৩ মেয়েকে নিয়ে স্ত্রীর আয়ের উপরও নির্ভর করে জীবন ও জীবিকা চালিয়ে যেতে হয়।

দু:খ ভারাক্রান্ত মনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ সর্দার জানান, আমার ছেলে মেয়েদেরকে ভাল স্কুল কলেজে ভর্তির জন্য অনেক মুক্তিযোদ্ধাসহ নেতা-নেত্রীর নিকট ধরনা দিয়েছি বিনিময়ে তিরস্কার ছাড়া কিছুই পাইনি। জৈনক্য জনপ্রতিনিধি আমাকে সন্তানদের জীবন গড়ায় ভাল স্কুল কলেজে ভর্তিতে কোনরূপ সহায়তা করতে পারবেন না সাফ জানিয়ে দেন। কান্না জড়িত কন্ঠে ইউসুফ সর্দার জানান, তার স্ত্রী নাছিমা আক্তার সৌদি আরবের স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত বর্তমানে নাজরানের যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের চিকিৎসার কাজে আছেন। ১ ছেলে ৩ মেয়ের মধ্যে ছোট মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী, ২য় মেয়ে উসমানী মেডিকেল কলেজ পড়াশোনা করছে। এবং জৈষ্ঠ্য মেয়ে মাইজদী ডয়বেটিক হাসপাতালে কর্মরত রয়েছে। ডান পা সম্পূর্ণ অচল। ট্রেচার দিয়ে চলতে হয়। তিনি আরো বলেন, মুক্তিযোদ্ধা নান্নু চৌধুরী প্রায়ই আমার বাসায় এসে শারিরিক ও পারিবারিক খোজ কবর নেন।

দেশ শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন হওয়ার পর বিজয় উল্লাসে সেনা ক্যাম্পে অস্ত্র জমা দিয়ে নিজ বাড়িতে চলে আসেন। সহজ-সরল এই বীর মুক্তিযোদ্ধা কখনোই কল্পনা করেননি যে, যুদ্ধের পর ক্যাম্পের ছাড়পত্রটি একদিন কাজে আসবে। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েছেন, আগের মতো আর কাজকর্ম করতে পারেন না। শরীরে যখন শক্তি ছিল তখন কাজ করে সংসারের ঘানি টেনেছেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার দিন কাটছে অনেক কষ্টে।  মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়ে অনেকের অনেক সরকারি চাকরি হয়েছে, কিন্তু ইউসুফ সর্দারের সরকারি গেজেটে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও তিনি সার্টিফিকেট পাননি অজ্ঞাত এক রহস্যজনক কারণে। সার্টিফিকেট সংগ্রহের জন্য তিনি বছরের পর বছর থানা, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা হেড কোয়ার্টার, কুমিল্লা ও ঢাকায় ধরনা দিয়েছেন। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৮ বছরেও এই বীর মুক্তিযোদ্ধার করুণ আর্তনাদ কারো কানে পৌঁছায়নি। দুঃখে ও ক্ষোভে অশ্রুভেজা নয়নে বলেন, “এদেশে টাকার বিনিময়ে হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকিট পেয়েছেন, এমনকি শত শত রাজাকারও মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকিট নিয়ে ঘুরছে বীরদর্পে। বাঁচব আর কতদিন, মরার আগেও যদি সরকারিভাবে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটুকু পাই তবে মরেও শান্তি পাব।”

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও ভাতা পাননি পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ সর্দার

আপডেট সময় ১২:০০:০১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০১৯
শাহীন মীর্জা, কুমিল্লা থেকেঃ

স্বাধীনতার পর ৪৮ বছর অতিবাহিত হলেও বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ সর্দার এর আর্তনাদ কেউ শুনতে পায়নি। সড়ক দুর্ঘটনায় পা ভেঙ্গে বর্তমানে বিছানায় কাতরাচ্ছেন। জীবিকার প্রয়োজনে এই বৃদ্ধ বয়সেও ঘরে ট্রেচার নিয়ে স্ত্রী প্রবাসে থাকায় ঘরের কাজ কর্ম, রান্নাবান্না করতে হয়।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আদর্শ সদর উপজেলার দৌলতপুর ছায়াবিতান এর প্রায়াত মুসলেম সর্দারের ছেলে ইউসুফ সর্দার দেশমাতৃকার টানে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। দেশকে শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে পিতা মাতাকে রেখে ভারতে গিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে। ২নং সেক্টরের অধীনে ক্যাপ্টেন পাঠানের নেতৃত্বে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাক হানাদার বাহিনীর উপর। তার সহযোদ্ধা হাজীগঞ্জ রামপুরের ৪ জনের মধ্যে নোওহাটার জয়নাল ভাতা ও রেশন পায় অথচ পঙ্গুত্ব বরন করলেও মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ সর্দার সরকারি কোন ভাতাদি পাচ্ছেন না। জানা যায়, জেনারেল এমএজি ওসমানির স্বাক্ষরিত সনদ সহ বিভিন্ন তালিকায় ইউসুফ সর্দারের নাম লিপিবদ্ধ থাকলেও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা থেকে বঞ্চিত। তিনি পঙ্গু হওয়ায় ১ ছেলে, ৩ মেয়েকে নিয়ে স্ত্রীর আয়ের উপরও নির্ভর করে জীবন ও জীবিকা চালিয়ে যেতে হয়।

দু:খ ভারাক্রান্ত মনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ সর্দার জানান, আমার ছেলে মেয়েদেরকে ভাল স্কুল কলেজে ভর্তির জন্য অনেক মুক্তিযোদ্ধাসহ নেতা-নেত্রীর নিকট ধরনা দিয়েছি বিনিময়ে তিরস্কার ছাড়া কিছুই পাইনি। জৈনক্য জনপ্রতিনিধি আমাকে সন্তানদের জীবন গড়ায় ভাল স্কুল কলেজে ভর্তিতে কোনরূপ সহায়তা করতে পারবেন না সাফ জানিয়ে দেন। কান্না জড়িত কন্ঠে ইউসুফ সর্দার জানান, তার স্ত্রী নাছিমা আক্তার সৌদি আরবের স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত বর্তমানে নাজরানের যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের চিকিৎসার কাজে আছেন। ১ ছেলে ৩ মেয়ের মধ্যে ছোট মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী, ২য় মেয়ে উসমানী মেডিকেল কলেজ পড়াশোনা করছে। এবং জৈষ্ঠ্য মেয়ে মাইজদী ডয়বেটিক হাসপাতালে কর্মরত রয়েছে। ডান পা সম্পূর্ণ অচল। ট্রেচার দিয়ে চলতে হয়। তিনি আরো বলেন, মুক্তিযোদ্ধা নান্নু চৌধুরী প্রায়ই আমার বাসায় এসে শারিরিক ও পারিবারিক খোজ কবর নেন।

দেশ শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন হওয়ার পর বিজয় উল্লাসে সেনা ক্যাম্পে অস্ত্র জমা দিয়ে নিজ বাড়িতে চলে আসেন। সহজ-সরল এই বীর মুক্তিযোদ্ধা কখনোই কল্পনা করেননি যে, যুদ্ধের পর ক্যাম্পের ছাড়পত্রটি একদিন কাজে আসবে। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েছেন, আগের মতো আর কাজকর্ম করতে পারেন না। শরীরে যখন শক্তি ছিল তখন কাজ করে সংসারের ঘানি টেনেছেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার দিন কাটছে অনেক কষ্টে।  মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়ে অনেকের অনেক সরকারি চাকরি হয়েছে, কিন্তু ইউসুফ সর্দারের সরকারি গেজেটে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও তিনি সার্টিফিকেট পাননি অজ্ঞাত এক রহস্যজনক কারণে। সার্টিফিকেট সংগ্রহের জন্য তিনি বছরের পর বছর থানা, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা হেড কোয়ার্টার, কুমিল্লা ও ঢাকায় ধরনা দিয়েছেন। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৮ বছরেও এই বীর মুক্তিযোদ্ধার করুণ আর্তনাদ কারো কানে পৌঁছায়নি। দুঃখে ও ক্ষোভে অশ্রুভেজা নয়নে বলেন, “এদেশে টাকার বিনিময়ে হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকিট পেয়েছেন, এমনকি শত শত রাজাকারও মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকিট নিয়ে ঘুরছে বীরদর্পে। বাঁচব আর কতদিন, মরার আগেও যদি সরকারিভাবে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটুকু পাই তবে মরেও শান্তি পাব।”