১১ ডিসেম্বর (মুরাদনগর বার্তা ডেস্ক):
সুন্দরবনের শেলা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির ঘটনায় জলজ ও প্রাণিজ সম্পদের প্রায় একশ’ কোটি টাকার ক্ষতি হবে বলে আশংকা করছে বন বিভাগ। এ ঘটনায় মঙ্গলবার রাতেই মংলা থানায় জিডি করা হয়েছে। এছাড়া বন আইনে মামলার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বন বিভাগ। দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে গতকাল বুধবার সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক বেল্লাল হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া আরো একটি তদন্ত কমিটি করেছে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর।
মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় ‘এমভি ওটি সাউদার্ন স্টার সেভেন’ নামের ট্যাংকারটি নদীতে ডুবে যায়। এতে ট্যাংকারটিতে থাকা ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল নদীতে ছড়িয়ে পড়ে। বন বিভাগ সূত্র দাবি করেছে, সুন্দরবনের নন্দবালা থেকে আন্ধারমানিক পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার ডলফিনের অভয়াশ্রমসহ প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তেল ছড়িয়ে পড়ছে। দিনে দু’বার করে জোয়ারের কারণে তেলের আস্তরণ ঢুকে পড়ছে সুন্দরবনের আরো গভীরে। দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে আরো বিস্তীর্ণ এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ছড়িয়ে পড়া এ তেলের কারণে শুধু বনজ সম্পদই নয়, বিলুপ্ত প্রায় ইরাবতী ডলফিনসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, কুমির, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও কাকড়াসহ অসংখ্য জলজ প্রাণি হুমকির মুখে পড়বে।
মাছ মরে ভেসে উঠছে: গতকাল সরেজমিনে শেলা নদীসহ আশপাশের নদী ও খালে গিয়ে দেখা গেছে, বিস্তীর্ণ এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়েছে। নদীর পানিতে তেলের গন্ধ। জেলেরা তেলের আস্তরণের কারণে মাছ ধরতে পারছেন না। এ ছাড়া বন সংলগ্ন লোকালয়ের মানুষ নদীর পানি ব্যবহার করতে পারছেন না। বনের গাছের গোড়ায় তেলের আবরণ লেগে রয়েছে। ইতিমধ্যে মাছ মরে ভেসে উঠতে শুরু করেছে। খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক কার্তিক চন্দ্র সরকার ঘটনাস্থলে থেকে জানান, যে এলাকায় ট্যাংকারটি ডুবে গেছে সেটি ডলফিনের অভয়ারণ্য। এতে ডলফিন, কুমিরসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণি ও গাছপালার যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়।
জিডি-মামলা:ট্যাংকার ডুবিতে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ও জীব-বৈচিত্র্যের ১শ’ কোটি টাকার উপরে ক্ষতির আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে পূর্ব সুন্দরবন চাঁদপাই বন বিভাগের স্টেশন অফিসার আবুল কালাম আজাদ বাদি হয়ে মংলা থানায় জিডি করেছেন। এছাড়া বন আইনে ট্যাংকারটির মালিক কর্তৃপক্ষের নামে মামলা হচ্ছে। মামলার প্রক্রিয়া শুরুর কথা নিশ্চিত করে আবুল কালাম আজাদ ইত্তেফাককে জানান, ইতিমধ্যে মামলার কাগজপত্র বিভাগীয় কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। কার্যক্রম শেষে মামলাটি আদালতে যেতে দুএকদিন সময় লাগবে। মামলায় বাদি করা হয়েছে ডুবে যাওয়া জাহাজটির মালিক-কর্মচারীদের। মংলা থানার ওসি বেলায়েত হোসেন জিডি দায়েরের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি জানান, দুর্ঘটনা কবলিত ট্যাংকারটির মালিক পক্ষ থেকেও গতকাল একটি মামলা হয়েছে।
উদ্ধার কার্যক্রম: ডুবে যাওয়া ট্যাংকারটির মাস্টার মোকলেসুর রহমানের (৫০) কোনো খোঁজ গতকাল দুপুর পর্যন্ত পাননি উদ্ধার অভিযানে থাকা কোস্টগার্ড সদস্যরা। তারা সুন্দরবনের বিভিন্ন নদ-নদীতে তল্লাশী অভিযান শুরু করেছে। এছাড়া ডুবে যাওয়া ট্যাংকারটি উদ্ধারে দুটি নৌযান নিয়ে কাজ শুরু করেছে এর মালিক প্রতিষ্ঠান মেসার্স হারুণ অ্যান্ড কোং। আপাতত দুটি নৌযান দুই দিক থেকে সাউদার্ন স্টার-৭ কে আটকে রেখেছে, যাতে সেটি পুরোপুরি তলিয়ে না যায়।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান গতকাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ডুবে যাওয়া অয়েল ট্যাংকার উদ্ধারে নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল ও চট্টগ্রাম থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয়, নির্ভীক ও কান্ডারি-১০ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রওনা দিয়েছে। কান্ডারী-১০ ঘটনাস্থলে পৌঁছে ভাসমান তেলের উপরে এক ধরনের পাউডার ছিটিয়ে তেল নষ্ট করবে। বুধবার রাতেই জাহাজগুলো ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর কথা।
নৌবাহিনীর জাহাজে ডুবুরি থাকলেও তেল সরানোর মতো আধুনিক সরঞ্জাম নেই বলে জানিয়েছেন খুলনা অঞ্চলের কমান্ডার মনীর মল্লিক। তিনি বলছেন, সনাতন পদ্ধতিতে বাঁশ ও কলাগাছ ব্যবহার করে পানির উপরিতলের তেল আলাদা করে তারা সরানোর চেষ্টা করবেন।
ঘটনাস্থলে বন উপমন্ত্রী: পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সুন্দরবনের ইতিহাসে এতো বড় দুর্ঘটনা এর আগে ঘটেনি। তাই সুন্দরবন বাঁচাতে বন অভ্যন্তরের এ নৌরুট অচিরেই বন্ধ করতে হবে। তা না হলে সুন্দরবনকে রক্ষা করা যাবে না। উপমন্ত্রী বনবিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে বিষয়টির উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখার নির্দেশনা দেন। এ সময় বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খন্দকার রাকিবুল ইসলাম, প্রধান বন সংরক্ষক তপন কুমার দে, মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য অপারেশন আলতাফ হোসেন, বাগেরহাট জেলা প্রশাসকসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
দুটি তদন্ত কমিটি:পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আমির হোসাইন চৌধুরী জানান, শেলা নদীর মৃগমারী এলাকায় অয়েল ট্যাংকার ডুবির পর সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রেঞ্জ কর্মকর্তা ছাড়াও তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন চাঁদপাই স্টেশন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ ও ঢাংমারী স্টেশন কর্মকর্তা প্রবল চন্দ্র রায়। বুধবার সকাল থেকে কমিটি সরেজমিনে তদন্ত শুরু করেছে। এই কমিটি তিন কর্মদিবসের মধ্যে ডিএফও’র নিকট তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে।
অন্যদিকে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এ ঘটনায় ৩ সদস্যের আলাদা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিনকে আহবায়ক করে গঠিত এ কমিটির অপর সদস্যরা হলেন- সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর খুলনার অভ্যন্তরিণ জাহাজ পরিদর্শক আবু জাফর ও একই দপ্তরের বিশষ কর্মকর্তা নৌ-নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গোলাম মহিউদ্দিন। এই কমিটি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে।
সংকটে সুন্দরবন: ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে স্থলভাগের পরিমাণ ৪ হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার। আর ৪৫০টি ছোট-বড় নদী ও খাল নিয়ে জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবনে রয়েছে ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, বেঙ্গল টাইগার ও চিত্রল হরিণসহ ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরিসৃপ, ৩শ’ প্রজাতির পাখি, বিলুপ্ত প্রায় ইরাবতী ডলফিনসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, কুমির, ২১০ প্রজাতির মাছ, ১৩ প্রজাতির কাঁকড়া ও ২৬ প্রজাতির চিংড়ি। সুন্দরবনে দৃশ্যমান সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৫৮ কোটি ৯ হাজার ৮শ’ বিলিয়ন টাকা। এসব কারণে জাতিসংঘের ইউনেস্কো কমিশন ১৯৯৭ সালে ৬ ডিসেম্বর সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ ঘোষণা করে। সুন্দরবনের এ সম্পদের সবটাই এখন সংকটের মধ্যে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের প্রাথমিক হিসাব মতে, পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই ও শরনখোলা রেঞ্জের নন্দপাড়া নদী থেকে শেলা নদী হয়ে আন্ধারমানিক নদী পর্যন্ত জলজ প্রাণীসহ ডলফিনের অভয়াশ্রম এখন চরম অস্তিত্ব সংকটে। মঙ্গলবার এ অয়েল ট্যাংকার ডুবির পর থেকে এ অভয়াশ্রমে আর ডলফিনের দেখা মিলছে না। এসব এলাকার প্রায় ৫০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে গাছপালার শ্বাসমূলে তেলের আস্তরণ পড়ায় এসব গাছপালা দু’সপ্তাহের মধ্যে মরতে শুরু করতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন বিষেশজ্ঞরা ।
দায়ী কে?:সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের মতে, এ দুর্ঘটনায় সুন্দবনের ক্ষয়-ক্ষতির জন্য নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় অনেকটাই দায়ী। বার বার তারা চিঠি দিয়ে মন্ত্রণালয়কে সুন্দরবনের বুক চিরে এই রুট দিয়ে সব ধরনের জাহাজ চলাচল বন্ধ করার অনুরোধ করলেও তারা তা কখনো কানে তোলেনি। পলি পড়ে ঘষিয়াখালী-মংলা আন্তর্জাতিক নৌ চ্যানেলটি ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সুন্দরবন বিভাগের কোন অনুমতি না নিয়েই বনের অভ্যন্তরে বিকল্প রুট দিয়ে জাহাজ চলাচল শুরু করে। পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ডিএফও জানান, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে একের পর এক চিঠি দিয়েও আমরা জাহাজ চলাচল বন্ধ করতে পারেনি। আমরা যা আশংকা করেছিলাম তার থেকেও বড় দুর্ঘটনার শিকার হল সুন্দরবন।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ নভেম্বর ভোরে এই শেলা নদীতেই ডুবে যায় যাত্রীবাহী নৌযান এমভি শাহীদূত। ওই নৌযানটি এখনও উত্তোলন করা হয়নি। এমনকি দুর্ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি প্রতিবেদনও জমা দেয়নি।