ঢাকা ১১:২৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কৃষিঋণে ভোগান্তির পরও থেমে নেই বাঞ্ছারামপুরের নারী উদ্যোক্তা

ফয়সল আহমেদ খান,বাঞ্ছারামপুর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকেঃ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ছলিমাবাদ গ্রামের এক সন্তানের জননী নূরজাহান মীরা। স্বামী অনেক দিন ধরেই প্রবাস জীবনযাপন করছেন। স্বামী বিদেশে থাকায় মীরার হাতে অখন্ড অবসর। এই অবসর সময় কাটানোর ফাঁকে ফাঁকে সংসারের আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে তিনি স্বউদ্যোগে কিছু একটা করার চিন্তা-ভাবনা করেন। মীরার বাবা, একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তিনি মেয়ের ইচ্ছেতে সায় দিলেন। বাবা-মেয়ে মিলে শুরু করলেন গাভী পালন।

প্রথমে মাত্র দুটি বিদেশি জাতের গাভী দিয়ে তারা খামার শুরু করেন। কয়েক বছর যেতে না যেতেই গাভীর খামার থেকে মুনাফা আসতে শুরু করে। গাভী পালনের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের পরও প্রতি মাসে বেশ কিছু টাকা হাতে থাকে। এতে মীরার উৎসাহ বেড়ে যায়। তিনি ভাবেন, খামারটি যদি আরো বড় করা যায় তাহলে লাভের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য প্রয়োজন পুঁজির। পুঁজির চাহিদা পূরণের জন্য মীরা তার বাবাকে সঙ্গে নিয়ে বাঞ্ছারামপুর সদর উপজেলার কয়েকটি ব্যাংকে গেলেন।

কিন্তু কোনো ব্যাংকই তাকে কৃষি ঋণ দিতে রাজি হলো না। ইতোমধ্যেই মীরা জানতে পেরেছেন, কৃষি ও পল্লী ঋণ খাতে বাংলাদেশের সিডিউল ব্যাংকগুলো অনেক টাকা ঋণ বরাদ্দ করেছে (১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা)। তিনি স্থানীয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের এসএমই(স্মল মানি ইনভেষ্টমেন্ট) শাখায় যোগাযোগ করলেন। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে সরাসরি ঋণদানে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। তিনি বাঞ্ছারামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.শরিফুল ইসলামকে ফোন করলেন। অভিযোগ জানালেন। ইউএনও কথা বলেন, ব্যাংকের কর্তাদের সাথে।সেই একই কথা-তাদের পলিসি হলো নারী,সাংবাদিক,পুলিশ ও উকিলদের কোন প্রকার ঋণ দেয়া হয়না।তারা রিস্কি।

অথচ,সরকারি পলিসি তার শতভাগ উল্টো।তারা নারীদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে নারীদের ঋণ দিতে বলেন।কারন,নারীরা ঋণ খেলাপী হয় না।কে শোনে কার কথা!হতাশ হয় না মীরা।শেষে,মীরা একটি এনজিওতে গিয়ে খুব সহজেই ঋণ পেল। কিন্তু সেই ঋণের ওপর আরোপিত সুদের হার অস্বাভাবিক রকম বেশি।

মীরা-ভাবে,বাঞ্ছারামপুরে কৃষি ব্যাংক-ব্রাক ব্যাংক-ইউসিবিএল, ইসলামী, ন্যাশনাল, সোনালী,অগ্রনী,জনতা এসব ব্যাংকের সাইনবোর্ডে কেন নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয়া হয়-এমন নামধারী ব্যাংকগুলো আছে কি করতে ?

বাংলাদেশ ব্যাংক সিডিউল ব্যাংকগুলোকে তৃণমূল অর্থাৎ কৃষক পর্যায়ে সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ সুদে ঋণ প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে, সিডিউল ব্যাংকগুলো এমএফআই লিংকেজে কৃষি ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে এমএফআই পর্যায়ে সুদের হার হবে ১১ শতাংশ। এতে আরো বলা হয়েছে, ব্যাংক থেকে গৃহীত কৃষি ঋণ কৃষক পর্যায়ে বিতরণের ক্ষেত্রে এমএফআইগুলো মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) কর্তৃক নির্ধারিত সুদের হার অনুসরণ করবে। সমস্যাটি দেখা দিয়েছে এখানেই। এমআরএ কর্তৃক প্রণীত আইন অনুযায়ী, এনজিওগুলো তৃণমূল পর্যায়ে ঋণদানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ হারে সুদ চার্জ করতে পারে। এই শর্তের সুযোগ নিয়ে এনজিওগুলো কৃষক পর্যায়ে কৃষি ও পল্ট্রী ঋণ বিতরণকালে ২৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদ চার্জ করছে। যেহেতু দেশের সিডিউল ব্যাংকগুলোর গ্রাম পর্যায়ে শাখা নেই এবং লোকবল সংকট রয়েছে তাই তারা অনেকটা বাধ্য হয়েই এনজিওদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকারের একটি মহতী উদ্যোগের সফলতা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ১১ শতাংশ সুদে নারী উদ্যোক্তা ও কৃষকদের ঋণ দিতে বললেও বাস্তব ক্ষেত্রে তারা সেই ঋণ পাচ্ছে ২৭ শতাংশ সুদে। অথচ এ ক্ষেত্রে যদি শর্তারোপিত হতো যে ব্যাংক নিজে অথবা এনজিওদের মাধ্যমে যেভাবেই ঋণ বিতরণ করুক না কেন কৃষক পর্যায়ে সুদের হার কোনোভাবেই ১১ শতাংশের বেশি হবে না। ব্যাংকগুলো সরাসরি কৃষককে ঋণ দিলে তারা ১১ শতাংশ সুদ চার্জ করবে।

আর যদি এনজিওদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে এনজিও পর্যায়ে ব্যাংক রেটের (৫ শতাংশ) ওপর ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জ আরোপ করবে। আর এনজিওরা কৃষক পর্যায়ে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ১১ শতাংশ সুদারোপ করবে। এমন একটি শর্তারোপিত হলে খুব সহজেই এই সমস্যা তিরোহিত হতো। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ হলে তিনি বলেন, এনজিওরা যে উচ্চ সুদে কৃষকদের ঋণ দিচ্ছে এই তথ্য তারা পেয়েছেন। কিন্তু এনজিওগুলোর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে তারা ইতোমধ্যেই মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটিকে পত্র দিয়েছেন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, ‘এনজিওরা কৃষকদের ২৭ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে এটা খুবই বেশি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সিলিং নির্ধারণ করে দিতে পারত। তাহলে এই সমস্যা খুব সহজেই এড়ানো যেত’।

কৃষক ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি ঘাটতি মেটানোর জন্য বর্তমান সরকার নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে উন্নয়ন সহযোগীদের আপত্তি উপেক্ষা করে কৃষি খাতে ব্যাপক ভর্তুকি এবং ঋণ দিয়ে চলেছে সরকার। চলতি অর্থবছরের জন্য কৃষি ও পল্লী ঋণ খাতে মোট ১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ বরাদ্দ করা হয়েছে। সহজ শর্তে এই ঋণ কৃষকদের প্রদান করার কথা বিশেষ করে প্রান্তিক নারী কৃষক ও নারী উদ্যোক্তাদের। কিন্তু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর শাখা স্বল্পতা এবং লোকবল সংকটের কারণে তারা পল্লী এলাকায় কৃষি ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে কিছুটা দ্বিধান্বিত। এ ছাড়া কৃষি ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। তাই তারা এনজিওদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করছে। এতে তুলনামূলক স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ বিতরণের উদ্দেশ্য বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গবাদি-পশুপালন, হাঁস-মুরগি পালন, মাছচাষ, পানের বরজ তৈরি, গরু মোটাতাজাকরণ ইত্যাদি নানা খাতে এই ঋণ বিতরণের কথা রয়েছে। কিন্তু পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে গ্রামীণ নারীদের কৃষি ঋণ বিতরণ বেশ জটিল হয়ে পড়েছে। কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে এমন কিছু শর্ত দেয়া হয়েছে যা একজন সাধারণ কৃষকের পক্ষে পূরণ করা দুরূহ। যেমন, কৃষি ঋণের জন্য সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) রিপোর্ট নিতে হয়। এ ছাড়া জামানত দিতে হয়। এই জামানত নিতে গিয়ে কৃষকরা নানা সমস্যায় পতিত হন। ভূমি অফিস থেকে জমি খারিজ করতে সময় এবং অবৈধ অর্থ ব্যয় করতে হয়। আরো কিছু শর্ত পালন করতে হয় যা একজন কৃষক বা নারী উদ্যোক্তার পক্ষে সম্ভব হয় না।

কৃষি ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত ঋণ জামানত মুক্ত হলে ভালো হতো। এ ছাড়া পদ্ধতিগত জটিলতাও কমানো প্রয়োজন। অন্যথায় যত চেষ্টাই করা হোক না কেনো কৃষি ও পল্লী ঋণের সুফল প্রান্তিক চাষি ও নারী উদ্যোক্তারা ভোগ করতে পারবে না। এ ছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কৃষি ঋণে কিছুটা বাড়তি সুবিধা প্রদান করা যেত। উল্লেখ্য, গ্রামীণ নারীরা এখন সাধারণ কৃষি কাজের বাইরে নানা ধরনের উদ্ভাবনীমূলক কর্মেও যুক্ত হচ্ছেন। অর্থাৎ তারা বিনা পারিশ্রমিকের কৃষিকর্মী থেকে উদ্যোক্তায় পরিণত হতে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় তাদের প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন। কিন্তু আমরা কি তাদের জন্য বিনিয়োগবান্ধব অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারছি? আইনি এবং পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে অনেক ভালো উদ্যোগও ব্যর্থ হচ্ছে। তাই গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসাবান্ধব অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এবং নারীরা যেন পল্লী ঋণ নিয়ে খুব সহজেই বিনিয়োগ করতে পারে সে জন্য সব সরকারি ব্যাংককে আরো উদ্যোগী হতে হবে।

কেস ষ্টাডি : আঞ্জুম আরা মেরিন এবং সেলিমা আহমাদ মেরী
পরিশ্রম সাফল্যের চাবিকাঠি। এ কথাটা সব সময় বিশ্বাস করেন আঞ্জুম আরা মেরিন। তাই কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে আজ গৃহিণী থেকে নারী উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পেরেছেন। শুধু পুতুল বানিয়ে মাসে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করে সংসারে অবদান রেখে চলেছেন আর দশটা পুরুষের মতো।

আঞ্জুম আরা মেরিন বড় হয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার দরিয়াদৌলত গ্রামে। পড়াশোনা করা অবস্থাতেই বিয়ে হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তার স্বামী মারা যান। তাই খুব অল্প বয়সে জীবনের কঠিন অধ্যায়ের সম্মুখীন হতে হয়। নিজের একমাত্র কন্যাসন্তান নিয়ে শুরু করেন জীবন সংগ্রাম। ১৯৯৫ সালে মাত্র তিন হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে পুতুল বানানোর ব্যবসা শুরু করেন। সাফল্যের দ্বারে পৌঁছানোর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে কঠিন সময়ের মোকাবেলা করতে হয়েছে তাকে। সব সংগ্রাম পেছনে ফেলে তিনি এখন একজন উঠতি নারী উদ্যোক্তা।বর্তমানে থাকেন রাজধানী ঢাকাতে।

পুঁজি না থাকায় আঞ্জুম আরা প্রথমে হাতের কাজ দিয়ে কিছু তৈরি করার চিন্তা করেন। তারপর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে খুব অল্প পুঁজি নিয়ে কাপড় দিয়ে বিভিন্ন আকর্ষণীয় জিনিস তৈরি শুরু করেন। বিশেষ করে পুতুল তৈরি করতে তার খুব ভালো লাগত। এর পাশাপাশি কাপড়ের ব্যাগ, পাপোশ, বেড কভারে নকশা করা, কুশন কভার, টেবিল ক্লথ, বিভিন্ন খেলনা হাতি, কুকুর এসবও তৈরি করেছেন। তা ছাড়া ঘর সাজানোর বিভিন্ন শোপিসও তৈরি করেছেন। তবে সবকিছুর মধ্যে কাপড়ের তৈরি খেলনা পুতুল বানিয়ে তিনি অর্থ ও প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এখন দেশে আঞ্জুম আরাদের মতো অনেক নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। নিজের পুঁজি আর সরকারের সহায়তায় তারা আজ নিজেদের পণ্য তুলে ধরছেন বিশ্বের বুকে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে পুরুষের পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের ভূমিকা অপরিহার্য। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন নারী। বিরোধী দলের নেতা হিসেবেও নারীর অবস্থান নব্বইয়ের দশক থেকে। অনেক বছর যাবৎ শীর্ষ পদে নারী থাকলেও নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা সেভাবে বাড়েনি। বর্তমান সরকার নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করায় এখন নারীরা ক্ষুদ্র ও বড় পরিসরে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।কিন্তু,মফস্বল বা উপজেলাগুলোতে সেটি অনুপস্থিত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীরা এক সময় গতানুগতিক ধারার মধ্যে আবদ্ধ ছিল। চাকরি কিংবা শ্রমিক-এই দুটো ক্ষেত্রেই মূলত নারীদের বাইরে কাজ করার প্রচলন ছিল। ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল শুধুই পুরুষের। তবে এখন সময় বদলেছে। বিনিয়োগ করে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। গড়ে তুলছে ছোট-বড় অনেক প্রতিষ্ঠান। তাদের এসব প্রতিষ্ঠানেই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে অনেক বেকার নারীকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ মতে, দেশের ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র ১৬ হাজার ৬৯৭ জন। বিদেশে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত ৭৬ লাখ প্রবাসীর মধ্যে ৮২ হাজার ৫৫৮ জন নারী। নারীদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার আগ্রহকে সহায়তা প্রদানে এগিয়ে এসেছে সরকার। বাজেটে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে নারীদের জন্য, একই সঙ্গে ব্যাংক থেকে ঋণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে কম সুদে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে নারী উন্নয়ন বাজেট ছিল ২৭ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ৭১ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৯২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। মোট বাজেটের হিসাবে নারী উন্নয়নে বরাদ্দের শতকরা হার বৃদ্ধি পেয়েছে ২৭.২৫ শতাংশ।

এতে সম্পৃক্ত ৪০টি মন্ত্রণালয়কে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। নারী উদ্যোক্তা সংগঠক এবং বাংলাদেশ ওমেন্স বিজনেস এসোসিয়েশনের সভানেত্রী,নিটোল-টাটা গ্রুপের পরিচালক,আওয়ামীলীগের কুমিল্লা উত্তরজেলার উপদেষ্টা ও পার্শ্ববর্তী উপজেলা কুমিল্লার হোমনা উপজেলার পাথালিয়াকান্দি গ্রামের মেয়ে
সেলিমা আহমাদ মেরী বলেন, ‘‘নারীরা দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে বিরাট ভূমিকা রাখছেন। কারণ দেশের মোট জনশক্তির অর্ধেকই নারী। কিন্তু উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য একজন পুরুষ যেসব সুযোগ-সুবিধা পান, একজন নারী তা পান না। অথচ ৯৭ থেকে ৯৯ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাই ব্যাংক থেকে জামানতবিহীন ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করেন, যা একটি বিরাট সাফল্য। এসব প্রতিকূলতার কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নারীরা এগিয়ে আসতে পারছেন না। যারা এগিয়ে এসেছেন তারা নিজ উদ্যোগেই আসছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এসএমই এবং নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে আগের চেয়ে এখন ঋণ বিতরণের পরিমাণ বাড়িয়েছে। গত বছর সোয়া সাত লাখ উদ্যোক্তার মাঝে বিতরণকৃত ১ লাখ ১৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকার ৫২ শতাংশই বিতরণ করা হয়েছে সাড়ে ছয় লাখ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার মাঝে। এ ঋণের মধ্যে নারী উদ্যোক্তা পেয়েছেন ৪ হাজার ২২৭ কোটি টাকা এবং সোয়া এক লাখ নতুন উদ্যোক্তা পেয়েছেন সাড়ে বিশ হাজার কোটি টাকা। ২০১৫ সাল পর্যন্ত পঞ্চাশ হাজার উদ্যোক্তাকে ৫ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা পুনঃঅর্থায়ন করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার নারী উদ্যোক্তার অনুকূলে পুনঃঅর্থায়ন করা হয়েছে ১ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা।’’

এ ছাড়া দেশের ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের পুরোটাই নারীদের কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। প্রায় পাঁচ হাজার ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক প্রান্তিক পর্যায়ের প্রায় আড়াই কোটি দরিদ্র নারী। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে নারীরা যেমন আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছেন, তেমনি অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির সর্বশেষ হিসাবে দেশে ক্ষুদ্র ঋণের গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ গ্রাহকই নারী। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অবদান বেড়েছে এটা ঠিক। কিন্তু পুরুষের অবদান যেখানে ৮০ শতাংশের ওপরে, সেখানে নারীর অংশ মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। আমাদের সমাজব্যবস্থা, চিন্তা-চেতনা ৪০ বছর আগের ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু আমাদের আরো পরিবর্তন হতে হবে। তা না হলে নারীরা তার কাংক্ষীত সোপানে পৌঁছাতে পারবে না।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

মুরাদনগরে মাদ্রাসায় যান না পাঁচ বছর নিয়মিত বেতন তোলেন শিক্ষক

কৃষিঋণে ভোগান্তির পরও থেমে নেই বাঞ্ছারামপুরের নারী উদ্যোক্তা

আপডেট সময় ০১:৩৪:৩৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ এপ্রিল ২০১৮
ফয়সল আহমেদ খান,বাঞ্ছারামপুর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকেঃ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ছলিমাবাদ গ্রামের এক সন্তানের জননী নূরজাহান মীরা। স্বামী অনেক দিন ধরেই প্রবাস জীবনযাপন করছেন। স্বামী বিদেশে থাকায় মীরার হাতে অখন্ড অবসর। এই অবসর সময় কাটানোর ফাঁকে ফাঁকে সংসারের আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে তিনি স্বউদ্যোগে কিছু একটা করার চিন্তা-ভাবনা করেন। মীরার বাবা, একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তিনি মেয়ের ইচ্ছেতে সায় দিলেন। বাবা-মেয়ে মিলে শুরু করলেন গাভী পালন।

প্রথমে মাত্র দুটি বিদেশি জাতের গাভী দিয়ে তারা খামার শুরু করেন। কয়েক বছর যেতে না যেতেই গাভীর খামার থেকে মুনাফা আসতে শুরু করে। গাভী পালনের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের পরও প্রতি মাসে বেশ কিছু টাকা হাতে থাকে। এতে মীরার উৎসাহ বেড়ে যায়। তিনি ভাবেন, খামারটি যদি আরো বড় করা যায় তাহলে লাভের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য প্রয়োজন পুঁজির। পুঁজির চাহিদা পূরণের জন্য মীরা তার বাবাকে সঙ্গে নিয়ে বাঞ্ছারামপুর সদর উপজেলার কয়েকটি ব্যাংকে গেলেন।

কিন্তু কোনো ব্যাংকই তাকে কৃষি ঋণ দিতে রাজি হলো না। ইতোমধ্যেই মীরা জানতে পেরেছেন, কৃষি ও পল্লী ঋণ খাতে বাংলাদেশের সিডিউল ব্যাংকগুলো অনেক টাকা ঋণ বরাদ্দ করেছে (১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা)। তিনি স্থানীয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের এসএমই(স্মল মানি ইনভেষ্টমেন্ট) শাখায় যোগাযোগ করলেন। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে সরাসরি ঋণদানে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। তিনি বাঞ্ছারামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.শরিফুল ইসলামকে ফোন করলেন। অভিযোগ জানালেন। ইউএনও কথা বলেন, ব্যাংকের কর্তাদের সাথে।সেই একই কথা-তাদের পলিসি হলো নারী,সাংবাদিক,পুলিশ ও উকিলদের কোন প্রকার ঋণ দেয়া হয়না।তারা রিস্কি।

অথচ,সরকারি পলিসি তার শতভাগ উল্টো।তারা নারীদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে নারীদের ঋণ দিতে বলেন।কারন,নারীরা ঋণ খেলাপী হয় না।কে শোনে কার কথা!হতাশ হয় না মীরা।শেষে,মীরা একটি এনজিওতে গিয়ে খুব সহজেই ঋণ পেল। কিন্তু সেই ঋণের ওপর আরোপিত সুদের হার অস্বাভাবিক রকম বেশি।

মীরা-ভাবে,বাঞ্ছারামপুরে কৃষি ব্যাংক-ব্রাক ব্যাংক-ইউসিবিএল, ইসলামী, ন্যাশনাল, সোনালী,অগ্রনী,জনতা এসব ব্যাংকের সাইনবোর্ডে কেন নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয়া হয়-এমন নামধারী ব্যাংকগুলো আছে কি করতে ?

বাংলাদেশ ব্যাংক সিডিউল ব্যাংকগুলোকে তৃণমূল অর্থাৎ কৃষক পর্যায়ে সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ সুদে ঋণ প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে, সিডিউল ব্যাংকগুলো এমএফআই লিংকেজে কৃষি ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে এমএফআই পর্যায়ে সুদের হার হবে ১১ শতাংশ। এতে আরো বলা হয়েছে, ব্যাংক থেকে গৃহীত কৃষি ঋণ কৃষক পর্যায়ে বিতরণের ক্ষেত্রে এমএফআইগুলো মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) কর্তৃক নির্ধারিত সুদের হার অনুসরণ করবে। সমস্যাটি দেখা দিয়েছে এখানেই। এমআরএ কর্তৃক প্রণীত আইন অনুযায়ী, এনজিওগুলো তৃণমূল পর্যায়ে ঋণদানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ হারে সুদ চার্জ করতে পারে। এই শর্তের সুযোগ নিয়ে এনজিওগুলো কৃষক পর্যায়ে কৃষি ও পল্ট্রী ঋণ বিতরণকালে ২৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদ চার্জ করছে। যেহেতু দেশের সিডিউল ব্যাংকগুলোর গ্রাম পর্যায়ে শাখা নেই এবং লোকবল সংকট রয়েছে তাই তারা অনেকটা বাধ্য হয়েই এনজিওদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকারের একটি মহতী উদ্যোগের সফলতা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ১১ শতাংশ সুদে নারী উদ্যোক্তা ও কৃষকদের ঋণ দিতে বললেও বাস্তব ক্ষেত্রে তারা সেই ঋণ পাচ্ছে ২৭ শতাংশ সুদে। অথচ এ ক্ষেত্রে যদি শর্তারোপিত হতো যে ব্যাংক নিজে অথবা এনজিওদের মাধ্যমে যেভাবেই ঋণ বিতরণ করুক না কেন কৃষক পর্যায়ে সুদের হার কোনোভাবেই ১১ শতাংশের বেশি হবে না। ব্যাংকগুলো সরাসরি কৃষককে ঋণ দিলে তারা ১১ শতাংশ সুদ চার্জ করবে।

আর যদি এনজিওদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে এনজিও পর্যায়ে ব্যাংক রেটের (৫ শতাংশ) ওপর ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জ আরোপ করবে। আর এনজিওরা কৃষক পর্যায়ে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ১১ শতাংশ সুদারোপ করবে। এমন একটি শর্তারোপিত হলে খুব সহজেই এই সমস্যা তিরোহিত হতো। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ হলে তিনি বলেন, এনজিওরা যে উচ্চ সুদে কৃষকদের ঋণ দিচ্ছে এই তথ্য তারা পেয়েছেন। কিন্তু এনজিওগুলোর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে তারা ইতোমধ্যেই মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটিকে পত্র দিয়েছেন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, ‘এনজিওরা কৃষকদের ২৭ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে এটা খুবই বেশি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সিলিং নির্ধারণ করে দিতে পারত। তাহলে এই সমস্যা খুব সহজেই এড়ানো যেত’।

কৃষক ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি ঘাটতি মেটানোর জন্য বর্তমান সরকার নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে উন্নয়ন সহযোগীদের আপত্তি উপেক্ষা করে কৃষি খাতে ব্যাপক ভর্তুকি এবং ঋণ দিয়ে চলেছে সরকার। চলতি অর্থবছরের জন্য কৃষি ও পল্লী ঋণ খাতে মোট ১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ বরাদ্দ করা হয়েছে। সহজ শর্তে এই ঋণ কৃষকদের প্রদান করার কথা বিশেষ করে প্রান্তিক নারী কৃষক ও নারী উদ্যোক্তাদের। কিন্তু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর শাখা স্বল্পতা এবং লোকবল সংকটের কারণে তারা পল্লী এলাকায় কৃষি ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে কিছুটা দ্বিধান্বিত। এ ছাড়া কৃষি ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। তাই তারা এনজিওদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করছে। এতে তুলনামূলক স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ বিতরণের উদ্দেশ্য বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গবাদি-পশুপালন, হাঁস-মুরগি পালন, মাছচাষ, পানের বরজ তৈরি, গরু মোটাতাজাকরণ ইত্যাদি নানা খাতে এই ঋণ বিতরণের কথা রয়েছে। কিন্তু পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে গ্রামীণ নারীদের কৃষি ঋণ বিতরণ বেশ জটিল হয়ে পড়েছে। কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে এমন কিছু শর্ত দেয়া হয়েছে যা একজন সাধারণ কৃষকের পক্ষে পূরণ করা দুরূহ। যেমন, কৃষি ঋণের জন্য সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) রিপোর্ট নিতে হয়। এ ছাড়া জামানত দিতে হয়। এই জামানত নিতে গিয়ে কৃষকরা নানা সমস্যায় পতিত হন। ভূমি অফিস থেকে জমি খারিজ করতে সময় এবং অবৈধ অর্থ ব্যয় করতে হয়। আরো কিছু শর্ত পালন করতে হয় যা একজন কৃষক বা নারী উদ্যোক্তার পক্ষে সম্ভব হয় না।

কৃষি ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত ঋণ জামানত মুক্ত হলে ভালো হতো। এ ছাড়া পদ্ধতিগত জটিলতাও কমানো প্রয়োজন। অন্যথায় যত চেষ্টাই করা হোক না কেনো কৃষি ও পল্লী ঋণের সুফল প্রান্তিক চাষি ও নারী উদ্যোক্তারা ভোগ করতে পারবে না। এ ছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কৃষি ঋণে কিছুটা বাড়তি সুবিধা প্রদান করা যেত। উল্লেখ্য, গ্রামীণ নারীরা এখন সাধারণ কৃষি কাজের বাইরে নানা ধরনের উদ্ভাবনীমূলক কর্মেও যুক্ত হচ্ছেন। অর্থাৎ তারা বিনা পারিশ্রমিকের কৃষিকর্মী থেকে উদ্যোক্তায় পরিণত হতে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় তাদের প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন। কিন্তু আমরা কি তাদের জন্য বিনিয়োগবান্ধব অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারছি? আইনি এবং পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে অনেক ভালো উদ্যোগও ব্যর্থ হচ্ছে। তাই গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসাবান্ধব অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এবং নারীরা যেন পল্লী ঋণ নিয়ে খুব সহজেই বিনিয়োগ করতে পারে সে জন্য সব সরকারি ব্যাংককে আরো উদ্যোগী হতে হবে।

কেস ষ্টাডি : আঞ্জুম আরা মেরিন এবং সেলিমা আহমাদ মেরী
পরিশ্রম সাফল্যের চাবিকাঠি। এ কথাটা সব সময় বিশ্বাস করেন আঞ্জুম আরা মেরিন। তাই কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে আজ গৃহিণী থেকে নারী উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পেরেছেন। শুধু পুতুল বানিয়ে মাসে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করে সংসারে অবদান রেখে চলেছেন আর দশটা পুরুষের মতো।

আঞ্জুম আরা মেরিন বড় হয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার দরিয়াদৌলত গ্রামে। পড়াশোনা করা অবস্থাতেই বিয়ে হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তার স্বামী মারা যান। তাই খুব অল্প বয়সে জীবনের কঠিন অধ্যায়ের সম্মুখীন হতে হয়। নিজের একমাত্র কন্যাসন্তান নিয়ে শুরু করেন জীবন সংগ্রাম। ১৯৯৫ সালে মাত্র তিন হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে পুতুল বানানোর ব্যবসা শুরু করেন। সাফল্যের দ্বারে পৌঁছানোর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে কঠিন সময়ের মোকাবেলা করতে হয়েছে তাকে। সব সংগ্রাম পেছনে ফেলে তিনি এখন একজন উঠতি নারী উদ্যোক্তা।বর্তমানে থাকেন রাজধানী ঢাকাতে।

পুঁজি না থাকায় আঞ্জুম আরা প্রথমে হাতের কাজ দিয়ে কিছু তৈরি করার চিন্তা করেন। তারপর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে খুব অল্প পুঁজি নিয়ে কাপড় দিয়ে বিভিন্ন আকর্ষণীয় জিনিস তৈরি শুরু করেন। বিশেষ করে পুতুল তৈরি করতে তার খুব ভালো লাগত। এর পাশাপাশি কাপড়ের ব্যাগ, পাপোশ, বেড কভারে নকশা করা, কুশন কভার, টেবিল ক্লথ, বিভিন্ন খেলনা হাতি, কুকুর এসবও তৈরি করেছেন। তা ছাড়া ঘর সাজানোর বিভিন্ন শোপিসও তৈরি করেছেন। তবে সবকিছুর মধ্যে কাপড়ের তৈরি খেলনা পুতুল বানিয়ে তিনি অর্থ ও প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এখন দেশে আঞ্জুম আরাদের মতো অনেক নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। নিজের পুঁজি আর সরকারের সহায়তায় তারা আজ নিজেদের পণ্য তুলে ধরছেন বিশ্বের বুকে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে পুরুষের পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের ভূমিকা অপরিহার্য। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন নারী। বিরোধী দলের নেতা হিসেবেও নারীর অবস্থান নব্বইয়ের দশক থেকে। অনেক বছর যাবৎ শীর্ষ পদে নারী থাকলেও নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা সেভাবে বাড়েনি। বর্তমান সরকার নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করায় এখন নারীরা ক্ষুদ্র ও বড় পরিসরে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।কিন্তু,মফস্বল বা উপজেলাগুলোতে সেটি অনুপস্থিত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীরা এক সময় গতানুগতিক ধারার মধ্যে আবদ্ধ ছিল। চাকরি কিংবা শ্রমিক-এই দুটো ক্ষেত্রেই মূলত নারীদের বাইরে কাজ করার প্রচলন ছিল। ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল শুধুই পুরুষের। তবে এখন সময় বদলেছে। বিনিয়োগ করে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। গড়ে তুলছে ছোট-বড় অনেক প্রতিষ্ঠান। তাদের এসব প্রতিষ্ঠানেই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে অনেক বেকার নারীকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ মতে, দেশের ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র ১৬ হাজার ৬৯৭ জন। বিদেশে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত ৭৬ লাখ প্রবাসীর মধ্যে ৮২ হাজার ৫৫৮ জন নারী। নারীদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার আগ্রহকে সহায়তা প্রদানে এগিয়ে এসেছে সরকার। বাজেটে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে নারীদের জন্য, একই সঙ্গে ব্যাংক থেকে ঋণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে কম সুদে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে নারী উন্নয়ন বাজেট ছিল ২৭ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ৭১ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৯২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। মোট বাজেটের হিসাবে নারী উন্নয়নে বরাদ্দের শতকরা হার বৃদ্ধি পেয়েছে ২৭.২৫ শতাংশ।

এতে সম্পৃক্ত ৪০টি মন্ত্রণালয়কে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। নারী উদ্যোক্তা সংগঠক এবং বাংলাদেশ ওমেন্স বিজনেস এসোসিয়েশনের সভানেত্রী,নিটোল-টাটা গ্রুপের পরিচালক,আওয়ামীলীগের কুমিল্লা উত্তরজেলার উপদেষ্টা ও পার্শ্ববর্তী উপজেলা কুমিল্লার হোমনা উপজেলার পাথালিয়াকান্দি গ্রামের মেয়ে
সেলিমা আহমাদ মেরী বলেন, ‘‘নারীরা দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে বিরাট ভূমিকা রাখছেন। কারণ দেশের মোট জনশক্তির অর্ধেকই নারী। কিন্তু উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য একজন পুরুষ যেসব সুযোগ-সুবিধা পান, একজন নারী তা পান না। অথচ ৯৭ থেকে ৯৯ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাই ব্যাংক থেকে জামানতবিহীন ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করেন, যা একটি বিরাট সাফল্য। এসব প্রতিকূলতার কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নারীরা এগিয়ে আসতে পারছেন না। যারা এগিয়ে এসেছেন তারা নিজ উদ্যোগেই আসছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এসএমই এবং নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে আগের চেয়ে এখন ঋণ বিতরণের পরিমাণ বাড়িয়েছে। গত বছর সোয়া সাত লাখ উদ্যোক্তার মাঝে বিতরণকৃত ১ লাখ ১৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকার ৫২ শতাংশই বিতরণ করা হয়েছে সাড়ে ছয় লাখ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার মাঝে। এ ঋণের মধ্যে নারী উদ্যোক্তা পেয়েছেন ৪ হাজার ২২৭ কোটি টাকা এবং সোয়া এক লাখ নতুন উদ্যোক্তা পেয়েছেন সাড়ে বিশ হাজার কোটি টাকা। ২০১৫ সাল পর্যন্ত পঞ্চাশ হাজার উদ্যোক্তাকে ৫ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা পুনঃঅর্থায়ন করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার নারী উদ্যোক্তার অনুকূলে পুনঃঅর্থায়ন করা হয়েছে ১ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা।’’

এ ছাড়া দেশের ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের পুরোটাই নারীদের কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। প্রায় পাঁচ হাজার ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক প্রান্তিক পর্যায়ের প্রায় আড়াই কোটি দরিদ্র নারী। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে নারীরা যেমন আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছেন, তেমনি অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির সর্বশেষ হিসাবে দেশে ক্ষুদ্র ঋণের গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ গ্রাহকই নারী। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অবদান বেড়েছে এটা ঠিক। কিন্তু পুরুষের অবদান যেখানে ৮০ শতাংশের ওপরে, সেখানে নারীর অংশ মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। আমাদের সমাজব্যবস্থা, চিন্তা-চেতনা ৪০ বছর আগের ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু আমাদের আরো পরিবর্তন হতে হবে। তা না হলে নারীরা তার কাংক্ষীত সোপানে পৌঁছাতে পারবে না।