খেলাধূলা ডেস্কঃ
ভালোবাসার নদীর নীল জল এখন বেদনার আরশি। প্রেমের আকাশের আকাশিতে উড়ছে কষ্টের কালো মেঘ। আকাশি-নীলের আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ অভিযান যে ঝুলছে সুতায়! আইসল্যান্ডের সঙ্গে ড্র এবং ক্রোয়েশিয়ার কাছে হারের পর! ২০১৮ আসরে ওই ভালোবাসার নদীতে আবার জোয়ার উঠবে, প্রেমের আকাশে উড়বে স্বপ্নের পায়রা—এ বিশ্বাস করার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
আইসল্যান্ডের বিপক্ষে নাইজেরিয়ার জয়ে স্বপ্নের শূন্য ক্যানভাসে আবার পড়েছে রঙের এক পোঁচ। অতল হতাশায় তলিয়ে যেতে যেতে আবার আশার খড়কুটো আঁকড়ে ধরার উপলক্ষ। নাইজেরিয়ার বিপক্ষে শেষ ম্যাচ যদি জিততে পারে হোর্হে সাম্পাওলির দল, তাহলেই হয়তো…! প্রথম দুই ম্যাচের ছন্নছাড়া আর্জেন্টিনার জন্য সে কাজটি সহজ নয় সত্য। আবার বিশ্বকাপ জেতার লক্ষ্য নিয়ে রাশিয়ায় আসা দলটির পক্ষে অসম্ভবও তো নয়।
আর ইতিহাসও সাক্ষী দিচ্ছে অমন বৈরী অবস্থা থেকে আলবিসেলেস্তেদের ঘুরে দাঁড়ানোর।
১৯৯০ বিশ্বকাপের কথাই ধরুন না! ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ইতালিতে যায় ডিয়েগো ম্যারাডোনার দল। সেখানে কিনা প্রথম ম্যাচেই
আফ্রিকান অদম্য সিংহ ক্যামেরুনের কাছে হেরে যায় ০-১ গোলে! ওই পরিস্থিতি পেরিয়েও তো ফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। সোভিয়েত ইউনিয়নকে দ্বিতীয় খেলায় হারায় ২-০ গোলে আর শেষ ম্যাচে ১-১ গোলে ড্র করে রোমানিয়ার সঙ্গে। ৪ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন ক্যামেরুন; রোমানিয়া-আর্জেন্টিনার পয়েন্ট সমান ৩। পয়েন্টের মতো গোল পার্থক্যও একই সমতায় +১। কিন্তু রোমানিয়া চার গোল দিয়ে তিন গোল খেয়েছে; আর্জেন্টিনা তিন গোল দিয়ে দুই গোল খেয়েছে। বেশি গোল করায় রোমানিয়া গ্রুপ রানার্স-আপ; আর্জেন্টিনা তৃতীয়। সে বিশ্বকাপের ফরম্যাটই ম্যারাডোনার দলকে তুলে দেয় নক আউট পর্বে। সেবার ২৪ দল খেলে ছয় গ্রুপে। প্রতি গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন-রানার্স-আপের সঙ্গে ছয় গ্রুপের তৃতীয় হওয়া ছয় দলের মধ্যে সেরা চার দল ওঠে শেষ ষোলোতে। ওই সেরা চার তৃতীয়র একটি হয়ে নক আউট পর্বে যায় আর্জেন্টিনা। এরপর ব্রাজিল, যুগোস্লাভিয়া ও ইতালিকে হারিয়ে ফাইনালে।
লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনার জন্য অমন কিছু কি অসম্ভব!
অমন বিরূপ অবস্থা থেকে পরের রাউন্ডে যাওয়ার আরো ইতিহাস রয়েছে আর্জেন্টিনার। ১৯৭৪ বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে পোল্যান্ডের কাছে ২-৪ গোলে হারে তারা; পরের খেলায় ১-১ ড্র ইতালির সঙ্গে। কিন্তু শেষ ম্যাচে হাইতিকে ৩-১ গোলে হারিয়ে ঠিকই পরের রাউন্ডে পৌঁছে। ১৯৮২ বিশ্বকাপেও যেমন বেলজিয়ামের কাছে ০-১ গোলের হার দিয়ে শুরুর পর হাঙ্গেরিকে ৪-১ ও এল সালভাদরকে ২-০ গোলে হারিয়ে করে প্রাথমিক লক্ষ্যপূরণ।
আবার ইতিহাসের উল্টো দিকও দেখেছে আর্জেন্টিনার সমৃদ্ধ ফুটবল ইতিহাস। ২০০২ সালের সেই অসাধারণ দলটি যেমন পারেনি প্রথম রাউন্ডের চৌকাঠ ডিঙাতে। নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ১-০ গোলের জয়ের শুরুর পর দ্বিতীয় খেলায় ইংল্যান্ডের কাছে একই ব্যবধানে হারের ধকল সামলাতে পারেনি। শেষ ম্যাচে সুইডেনের সঙ্গে ১-১ ড্রতে গ্রুপে তৃতীয় হয়ে বাদ পড়ে যায়। ১৯৫৮ আসরে পশ্চিম জার্মানির কাছে ১-৩ গোলে হারের পর নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডকে ৩-১ গোলে হারিয়ে কক্ষপথে ফেরার ঘোষণা ছিল। সে জন্য শেষ ম্যাচে চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে জিততে হতো। ওই চাপেই কিনা ১-৬ গোলে হেরে যায় আর্জেন্টিনা! পরের বিশ্বকাপেও একই অবস্থা। প্রথম দুই খেলায় একটি করে জয়-হার, শেষ ম্যাচে হাঙ্গেরিকে হারানোর প্রয়োজনীয়তার মুখে দাঁড়িয়ে। গোলশূন্য ড্র করে গ্রুপে তৃতীয় হয়ে প্রথম রাউন্ডে ভোকাট্টা হয়ে যায় আর্জেন্টিনার স্বপ্নঘুড়ি।
চলতি বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচে আর্জেন্টিনার জয়হীন থাকাটা এমনিতেই বিস্ময়কর। সাম্প্রতিক আসরগুলোর শুরুর পারফরম্যান্স মনে করালে বিস্ময়ের পারদ চড়ে আরো উঁচুতে। ২০১৪ বিশ্বকাপে গ্রুপের তিন ম্যাচেই জিতেছিল আলবিসেলেস্তেরা—বসনিয়া, ইরান, নাইজেরিয়ার বিপক্ষে। ২০১০ আসরেও তাই—সেবার প্রতিপক্ষ ছিল নাইজেরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও গ্রিস। ২০০৬ সালে গ্রুপের শেষ ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করলেও কাজের কাজ করে রাখে তারা প্রথম দুই ম্যাচে—আইভরি কোস্ট ও সার্বিয়ার বিপক্ষে জয়ে। গেল তিন বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে অমন দাপুটে পারফরম্যান্সের পর এবারের হতশ্রী শুরু সমর্থকদের হতভম্ব না করে পারে না।
রাশিয়ায় তাই আর্জেন্টাইন সাংবাদিকদের ক্রুদ্ধ চেহারা চোখে পড়ছে মিডিয়া ট্রিবিউন, মিডিয়া সেন্টার, সংবাদ সম্মেলন কক্ষে। মস্কো-সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায়, ফ্যান জোনে আকাশি-সাদা জার্সির সমর্থকরা মুণ্ডপাত করছেন কোচের। ওদিকে ভীষণ তেতে আছেন স্বয়ং ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তবু মনের গোপন গহিনে সবাই চেয়ে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে গ্রুপের শেষ ম্যাচের দিকে।
না হয় বেদনার নীলে এখন স্থবির আর্জেন্টিনার ভালোবাসার নদী, সেটি স্রোতভাঙা জলপ্রপাতে বিস্ফোরিত হতে কতক্ষণ! না হয় কষ্টের মেঘে ঢাকা সেই প্রেমের আকাশ; সেই মেঘ ফুঁড়ে বজ্রের গর্জন উঠতে আর দেরি কী! নাইজেরিয়ার বিপক্ষে বড় ব্যবধানে জিতলেই তো…