স্বাস্থ্য:
কেস-১. মিসেস করিম তার মেয়ে শার্লিনকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। তাকে খুব উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। সার্লিন গত রাতে রাগ করে অনেকগুলো প্যারাসিটামল খেয়ে ফেলেছে। সকাল থেকে সে এলোমেলো কথা বলছে এবং চোখ হলুদ হয়ে এসেছে। কর্তব্যরত চিকিত্সক শার্লিন কতটা প্যারাসিটামল খেয়েছে জিজ্ঞাসা করায় মিসেস করিম অনুমানের ভিত্তিতে বললেন ১৫টার মত হবে।
কেস-৩. সামসুল হাসপাতালে মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছে জন্ডিস নিয়ে। এক মাস আগে যখন প্রথম জন্ডিস দেখা দিল, তখন ডাক্তার না দেখিয়ে তাকে কবিরাজের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কবিরাজ তাকে কিছু ভেষজ (হার্বাল) ওষুধ দেন। কিন্তু ওষুধ খাওয়ার কিছুদিন পরে তার জন্ডিস কমার পরিবর্তে আরও বেড়ে যায়। অবশেষে তার আত্মীয়রা তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।
উপরে তিনটি ঘটনাকে মেডিকেলের পরিভাষায় একটি কমন টার্মের অধীনে আলোচনা করা হয়। যাকে বলে Drug induced liver injury তথা ওষুধজনিত লিভারের ক্ষতি। আমরা প্রতিদিন হরেক রকম খাদ্য গ্রহণ করি। অসুস্থ মানুষদের নানাবিধ রোগের জন্য বিভিন্ন ধরনের ওষুধ সেবন করতে হয়। আমরা খাদ্যনালি দিয়ে যত প্রকার বস্তুই গ্রহণ করি না কেন সবকিছুই প্রাথমিক পরিপাকের পর অন্ত্রের রক্তনালি দিয়ে প্রথমে লিভারে প্রবেশ করে। এরপর লিভার থেকে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ঘটিয়ে তাকে হূিপণ্ডের মাধ্যমে সমগ্র শরীরে ছেড়ে ছেড়ে দেয়া হয়। আমাদের গৃহীত খাদ্যে নানা ধরনের কেমিক্যাল উপস্থিতির কারণে লিভারকে প্রতিনিয়ত অসংখ্য ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রতিদিন কাজে ব্যস্ত লিভার মাঝে মাঝে অনাকাঙ্ক্ষিত রাসায়নিক পদার্থের পরিবর্তন করতে গিয়ে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আবার মাত্রাতিরিক্ত ওষুধের ডোজ পড়ে গেলেও লিভার ইনজুরেড হতে পারে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন লিভারের ক্ষতি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় হতে পারে। এর মধ্যে ড্রাগ অতিরিক্ত মাত্রায় বা দীর্ঘ সময় ধরে সেবনের ফলে সরাসরি লিভারের ক্ষতি করতে পারে। অন্যদিকে লিভার ইনজুরির মূল কারণটা অজানা থাকে। যাকে বলা হয় ইডিওসিনক্র্যাটিক রিএকশন। তবে ধারণা করা হয় যে ইডিওসিনক্র্যাটিক রিঅ্যাকশন বিপাক প্রক্রিয়া সম্পর্কিত এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত কিছু জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মিশ্র মিথষ্ক্রিয়ায় হয়ে থাকে। সাধারণত ওষুধ খাওয়া ৫ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে এই রিঅ্যাকশন হতে পারে। মানুষের জিন গত কারণে ইডিওসিনক্র্যাটিক রিএকশন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে এই প্রক্রিয়ায় কোন ব্যক্তির কোন ওষুধে সমস্যা হবে সেটা আগে থেকে কখনই নির্ণয় করা যায় না। বাংলাদেশে ওষুধ জনিত লিভার ইনজুর ঘটনা কম। সারা বিশ্বে লিভার ও পরিপাকতন্ত্র বিশেষজ্ঞরা যত বেশি রোগী দেখেন তার এক শতাংশের কম হলো ওষুধজনিত লিভার রোগী।
আমেরিকা ও ইউরোপের একিউট লিভার ফেইলুর সংক্রান্ত যত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয় তার প্রধান কারণ হলো ওষুধ জনিত লিভার রোগ। ওষুধজনিত লিভার ফেইলুর প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় ও চিকিত্সা না করতে পারলে মৃত্যুর সম্ভাবনা ৯০%। সুতরাং ওষুধজনিত লিভার ইনজুরির ঘটনা সংখ্যায় কম হলেও পরিণতিতে মারাত্মক।
যে কোনো ধরণের ওষুধই লিভার ইনজুরি করতে পারে। তবে সাধারণত যে ওষুধজনিত লিভার ইনজরি বেশি পাওয়া যায় সেগুলো হলো-প্যারাসিটামল, আইসোনিয়াজিড়, মিথোট্রিক্সেট, ফিনাইটয়েন এবং ভ্যালপ্রোয়েট।
কিছু ওষুধ আছে ডোজ ভিত্তিক ইনজুরি করে, ডোজ একটি নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি হলে লিভারের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং যত বেশি ডোজ হবে ইনজুরির মাত্রা তত বেশি হয়। এই ধরনের ওষুধের মধ্যে আছে-প্যারাসিটামল এবং মিথোট্রিক্সট। প্যারাসিটামল একটি সহজলভ্য ওষুধ, যা জ্বর ও ব্যথার জন্য ডাক্তাররা লিখে থাকেন। এটি ওষুধের দোকানে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওটিসি ড্রাগ হিসেবে পাওয়া যায়। একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত প্যারাসিটামল লিভারে কোনো চাপ সৃষ্টি করে না। তবে কেউ যদি এক সাথে ৭.৫ গ্রাম ওষুধ খেয়ে ফেলে তার নিশ্চিতভাবেই লিভার ইনজুরি হবে। অন্যদিকে মিথোট্রিক্সেট ওষুধটি বিভিন্ন রিউম্যাটোলজিক্যাল ও রক্তরোগে ব্যবহূত হয়। ডাক্তারদের উপদেশকৃত ডোজের চেয়ে বেশি মাত্রায় বা ঘন ঘন খেলে এটি লিভার ইনজুর করতে পারে।
আইসোনিয়াজিড ও রিফামপিসিন ওষুধ দুটি যক্ষ্মার চিকিত্সায় খেতে হয় প্রায় ছয় মাস। যক্ষ্মার চিকিত্সার জন্য ওষুধ দুটি যে মাত্রায় সেবন করতে বলা হয় সাধারণত সে মাত্রায় এরা কোনো অসুবিধা সৃষ্টি করে না। তবে কোন কোন কারণে ওষুধ দুটি লিভার ইনজুরি ও তত্জনিত জন্ডিসের কারণ হতে পারে। প্রোপাইল থায়োইউরাসিল হল হাইপারথাইরয়েডিজম নামক থাইরয়েড রোগের ওষুধ। ফিনায়টয়েন ও ভ্যালপ্রোয়েট প্রেসক্রাইব করা হয় খিচুনী নিয়ন্ত্রণ করতে। এ ওষুধগুলো রিঅ্যাকশন করে লিভার ইনজুরি করতে পারে। স্বল্পমেয়াদি লিভার প্রদাহে আক্রান্ত রোগী বা সিরোসিসের রোগী ভেষজ ওষুধ খেলে লিভার ফেইলুর হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়।
ওষুধজনিত লিভার রোগীরা বিভিন্ন ধরণের লক্ষণ প্রকাশ করতে পারে। কোন কোন রোগীর স্বল্পমেয়াদি লিভার প্রদাহের মত জন্ডিস, বমি বমি ভাব, পেটে ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। কারও কারও লিভার সিরোসিসের ন্যায় লক্ষণ প্রকাশ পায়। কেউ আবার লিভার ফেইলুর নিয়ে হাসপাতালেণ আসে। আবার কিছু মানুষের কোন লক্ষণই থাকে না। শুধুমাত্র রক্ত পরীক্ষা ALT বা AST স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া যায়। লিভার ফেইলিউর হলে রোগী এলোমেলো বকে বা চেতনা লোপ পায়।
ওষুধের কারণে সৃষ্ট লিভারের ক্ষতি নির্ণয় করার ক্ষেত্রে রোগী কি ওষুধ খাচ্ছে বা খেয়েছেন তা জানাটা গুরুত্বপূর্ণ। সেই সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অন্যান্য লিভার রোগ নেই এটি নিশ্চিত হওয়া গেলেই ধারণা করা হয় যে সংশ্লিষ্ট লিভার ইনজুরি ওষুধের কারণে হয়েছে। রোগ নির্ণয়ের প্রয়োজনে রক্তের টেস্ট এর পাশাপাশি লিভার বায়োপসিও করা লাগে।
লিভারের ক্ষতি ওষুধ থেকে হয়েছে নিশ্চিত হওয়া গেলে চিকিৎসার প্রথম ধাপ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ওষুধটি বন্ধ করে দেয়া। ইনজুরির মাত্রা কম হলে অনেক সময় ওষুধ বন্ধ করার অল্প দিনের মধ্যে লিভারের ফাংশন ঠিক হয়ে আসে। রিঅ্যাকশনের জন্য মূল চিকিৎসা হলো ওষুধ বন্ধ করে সাপোর্টিভ চিকিৎসা দেয়া। তবে লিভার ফেইলুর হয়ে গেলে অতি দ্রুত লিভার প্রতিস্থাপন করাই হচ্ছে সর্বশেষ চিকিৎসা। এছাড়া লক্ষণ ও কারণ ভেদে ভিটামিন কে, আর্সোডিঅক্সিকলিক অ্যাসিড এবং স্টেরয়েড ওষুধও উপকারে আসে।
ওষুধ খেলে যেহেতু লিভার ইনজুরি হবার সম্ভাবনা আছে, আমরা কি ওষুধ খাবো না। উত্তর: আমরা ওষুধ খাবো এবং আমাদের লিভার ইনজুরি নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই। কেননা কিছু কিছু ওষুধ যে মাত্রায় চিকিত্সার জন্য দেয়া হয় তাতে লিভারের কোন সমস্যা হয় না। অন্য দিকে রিএকশন এর ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বল্প মাত্রায় লিভার ইনজুরি করে যা সংশ্লিষ্ট ওষুধ সেবন বন্ধ করে দিলে অল্প সময়ের মধ্যে ভালো হয়ে যায়।
তবে ওষুধজনিত লিভার ইনজুরি থেকে বাঁচার জন্য সবচেয়ে বড়ো উপায় হচ্ছে চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করা এবং ওষুধ খাবার পর থেকে জন্ডিস, বমি বমি ভাব, পেটে ব্যথা ইত্যাদি সমস্যা হলে দেরী না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।
অতএব, আমাদের উচিত ওষুধ জনিত লিভার ইনজুরি সম্পর্কে নিজে সতর্ক হওয়া এবং অন্যদেরকেও সচেতন করা।
লেখক: পরিচালক
দি লিভার সেন্টার, ঢাকা, বাংলাদেশ
মির্জা গোলাম হাফিজ রোড
বাড়ি নং-৬৪, রোড নং-৮/এ
ধানমন্ডি, ঢাকা