খেলাধূলঅ ডেস্ক:
সৌদি আরবে এখন বেশ কয়েকটি বড় খেলার আসর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। রেসলিং প্রতিযোগিতা ফর্মুালা-ই মৌসুমের প্রথম পর্ব এর মধ্যেই শুরু হয়েছে আর এফওয়ান রেসের আয়োজন হতে যাচ্ছে ডিসেম্বরে।
দুই সপ্তাহ আগে স্পেন ঘোষণা দিয়েছে যে, চার দল নিয়ে স্প্যানিশ সুপার লীগের আগামী তিন আসর সৌদি আরবেই অনুষ্ঠিত হবে। ওই চার দল হলো- রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদ আর ভ্যালেন্সিয়া। তবে এই ঘোষণা সমালোচনার মুখে পড়েছে।
স্পেনের খেলাধুলা বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত জুনিয়র মন্ত্রী মারিয়া হোসে রেইন্দা বলেছেন, ‘সরকার এই প্রতিযোগিতা এমন দেশে অনুষ্ঠান করাকে সমর্থন করে না, যেখানে নারীদের অধিকারকে সম্মান করা হয়না’।
এই বক্তব্যের মধ্যেই সেই রহস্যেরই উত্তর লুকিয়ে আছে যে, সর্বশেষ দেশ হিসাবে কেন ও কীভাবে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ‘স্পোর্টসওয়াশিং’ বা ‘খেলার নামে ভুলানো’র অভিযোগ উঠেছে, যার মাধ্যমে খেলাধুলাকে ব্যবহার করে ওই দেশ সম্পর্কে মানুষের মনোভাব বদলের চেষ্টা করা হয়।
স্পোর্টসওয়াশিং বা খেলার নামে ভুলানো শব্দটি নতুন হতে পারে, কিন্তু প্রবণতাটি নয়। এই শব্দ প্রথমবার ব্যবহার করা হয় ২০১৫ সালে। সেই সময় আজারবাইজানের ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করা হতো। দেশটি তেল সম্পদে সমৃদ্ধ। কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের ইতিহাস রয়েছে, যার তথ্যপ্রমাণ হাজির করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
সেই বছর আতলেটিকো মাদ্রিদকে নিয়ে গিয়ে খেলাধুলার আসরে মনোযোগ কেড়েছিল আজারবাইজান। দেশটি ‘ইউরোপের অলিম্পিক’ নামে একটি নতুন ধরণের অলিম্পিকের আসরের আয়োজন করে রাজধানী বাকুতে। এ বছর পরে, রাজধানীর সড়কে অনুষ্ঠিত করা হয় প্রথম গ্র্যান্ড প্রিক্স। ২০১৯ সালের ইউরোপা লীগ ফাইনালের জন্য দরপত্রে অংশ নেয় বাকু এবং বিজয়ী হয়।
এর ফলে যখন ওই দেশের নামটি ইন্টারনেটের সার্চ ইঞ্জিনে লেখা হয়, তখন খেলাধুলা বিষয়ক এসব খবরই শীর্ষে উঠে আসে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা খবর নীচের দিকে চলে যায়। যখন ওই দেশটির নাম সংবাদে আসে, তখন বেশিরভাগ সময় আকর্ষণীয় নানা খেলার অনুষ্ঠানের খবর ভেসে আসে, যেখানে থাকে নামীদামী সব তারকার সংবাদও।
সেই সঙ্গে এসব নামীদামী তারকা ওই দেশে অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছে, এমন খবরের কারণে দর্শকদের কাছে একটি বার্তা যায় যে, সেখানকার পরিস্থিতি হয়তো ততটা খারাপ নয়।
জাতি বিদ্বেষ থাকার সময় দক্ষিণ আফ্রিকা অনেক ভালো-ভালো খেলার ইভেন্ট আয়োজন করেছিল, যার মধ্যে ১৯৮০ সালের গ্র্যান্ড প্রিক্স নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়েছে। এখন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, ঠিক একই কাজ করছে সৌদি আরব। দেশটির ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের দিকগুলো তুলে ধরেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
বাক স্বাধীনতার ওপর অত্যন্ত কড়া বিধিনিষেধ এবং নারী অধিকারহীনতা রয়েছে। পাশাপাশি অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া চালু রয়েছে, যদিও সেটাকে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অপরাধ বলে গণ্য করা হয় না। তুরস্কে সৌদি দূতাবাসের মধ্যে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যাকাণ্ডের পরে সৌদি আরবের এসব দিক বিশ্ববাসীর সামনে বড় করে বেরিয়ে এসেছে।
সৌদি আরব হয়ত ভাবছে, খেলাধুলার মাধ্যমে মানুষজন ওসব ব্যাপার নিয়ে কম ভাববে। যখন তারা সৌদি আরব শব্দ দুইটি শুনবে, তখন ওসব বিষয় বাদ দিয়ে বরং বড় বড় খেলার কথা ভাববে।
‘স্পোর্টসওয়াশিং’ পরিভাষাটি দুইটি কারণে বিশেষ করে কাজ করে। প্রথমত, বেশিরভাগর খেলাধুলার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো দাবি করে যে, তাদের খেলার আসরগুলোর সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নেই।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকার এবং খেলাধুলার মধ্যে আসলে কোন সম্পর্ক নেই। যেসব দেশে সরকার জাতীয় ফুটল অ্যাসোসিয়েশনে নাগ গলাতে গেছে সরকার, সেসব দেশকেই শাস্তি দিয়েছে ফিফা, এমনকি অনেক দেশকে টুর্নামেন্টে অংশ নেয়া থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এ কারণে যেসব দেশে রাজনৈতিক মুক্ত চর্চা অবরুদ্ধ হয়ে আছে, সেসব দেশ আকর্ষণীয় সব অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চায়। ফিফা এবং আন্তর্জাতিক অলিম্পিকের ওপর চাপ অব্যাহত আছে যেন এই সংস্থাগুলো এসব দেশে অনুষ্ঠান আয়োজন না করে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকের সময় তিব্বত পন্থীদের বিক্ষোভ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি।
এ নিয়ে বিতর্কের আরেকটি বিষয় হলো, এসব খেলাধুলার অনুষ্ঠান শুরুর সময় যেসব বিতর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর মনোযোগ খেলার দিকে চলে গেলেও, পরবর্তীতে আর ওই বিতর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয় না। যেমন ধরুন, যখন প্রতিদিন বিশ্বকাপ ফুটবলের চারটি করে ম্যাচ থাকে, সাংবাদিকদের আর অন্য কিছুর প্রতি মনোযোগ দেয়ার অবকাশ থাকে না।
২০১৬ সালের ব্রাজিল রিও অলিম্পিকের খরচ নিয়ে যেসব বিক্ষোভ হয়েছে, সেগুলোর খবর বিশ্বকাপ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় হাওয়া হয়ে গেছে। তখন ভেন্যুর ভেতরের খবর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, সৌদি আরবে লড়াই করতে রাজি হয়ে মুষ্টিযোদ্ধা অ্যান্থনি জোসুয়া আসলে প্রতারণার শিকার হয়েছে, কারণ সেখানে যারাই শাসকদের সমালোচনা করেছে সে বহিষ্কৃত, গ্রেপ্তার অথবা হুমকির শিকার হয়েছে। সেখানে বাক স্বাধীনতা বা প্রতিবাদ করার অধিকারের নূন্যতম কোন আভাস নেই।
খেলাধুলাকে ব্যবহার করে এই ‘স্পোর্টসওয়াশ’ পদ্ধতির মাধ্যমে বিতর্কের মুখে থাকা এসব দেশ তাদের নিজস্ব ‘স্ট্রাইস্যান্ড ইফেক্ট’ তৈরি করছে- যার মানে হলো, তারা যেসব জিনিস লুকিয়ে রাখতে চায়, তার ওপর থেকে বিশ্ববাসীর মনোযোগ সরিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছে।