তথ্যপ্রযুিক্তি ডেস্কঃ
এমনটি হবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। যেসব দেশের নীতিনির্ধারকরা হালকাভাবে বিষয়টিকে গ্রহণ করেছে, কখনো কখনো ‘ফ্যান্টাসি’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে আর দম্ভভরে প্রস্তুতি নেওয়াকে ‘রাষ্ট্রের মানসম্মানের বিষয়’ বলে এড়িয়ে গিয়েছে, সেসব দেশই এখন বেশি অসহায়। খেসারত দিচ্ছে নেতাদের আত্মম্ভরিতার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্র্যাম্পের কথা না হয় না-ই বললাম। তার আস্ফাালনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে করোনা ভাইরাসটি লাখো আমেরিকানের ঘাড়ে চেপে বসেছে আর প্রাণ নিচ্ছে প্রতিদিন গড়ে চার শতের বেশি মানুষের। ‘দ্বিতীয় ট্র্যাম্প’ বলে খ্যাত ব্রাজিলের রাষ্ট্রপ্রধান বলসোনারোকে পর্যন্ত মাত্র এক দিন আগে বলতে শোনা যায় :‘আমি দুঃখিত। কিছু মানুষকে মরতেই হবে। এটাই জীবন।’ ইতালির প্রধানমন্ত্রী তো হাল ছেড়ে দিয়ে ভাইরাসটির কাছে মনে হয় আত্মসমর্পণ করেই বসে আছেন, যার দেশে এরই মধ্যে প্রায় ছয় হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন আর আক্রান্ত হয়েছেন আশি হাজারের বেশি। তবে চীন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, হাতের কাছে লভ্য চিকিত্সার ব্যবহার আর সর্বশেষে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) প্রয়োগ করে ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। সময় থাকতে আমরা কি চীনের পথে হাঁটতে পারি না? চীন কী করেছে? চীন সরকার করোনা শনাক্তে হুয়াওয়ে নামক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করেছে এবং এখনো করছে। সফলতাও পেয়েছে। করোনা আক্রান্তদের কভিড-১৯ নির্ণয়ে দক্ষ ‘ইমেজিং’ চিকিত্সকের অভাব ছিল চীনে।
চীনের ‘জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন’ হুয়াওয়ের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির মাধ্যমে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় এবং চিকিত্সার পদ্ধতিটি ব্যবহার করছে। এক্ষেত্রে ‘সিটি কোয়ান্টিফিকেশন’ (CT Quantification) খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফল চিত্রাকারে প্রকাশ করতে পারে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চিপ-এর গণনা ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে খুব দ্রুত যে কোনো নমুনার ‘কোয়ান্টাইজেশন’ ফলাফল নির্ণয় করতে পারে। চীনের স্বাস্থ্য কমিশন সিটি কোয়ান্টিফিকেশনকে তাদের ‘ক্লিনিক্যাল ডায়াগনসিস স্ট্যান্ডার্ড’ হিসেবে গ্রহণ করে হুবেই প্রদেশে (যেখান থেকে করোনার উত্পত্তি হয়ে প্রথমে চীনে এবং পরে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে) স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ব্যবহার করা শুরু করে। চীনে হুয়াওয়ে ক্লাউডের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের কারণে ইমেজিং চিকিত্সকের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। হুবেই প্রদেশ এখন করোনামুক্ত। সমকালের একটি খবরে দেখা যায়, ‘ক্লিনিক্যাল তথ্য-উপাত্ত এবং গবেষণাগারে প্রাপ্ত ফলাফলের মধ্যে সমম্বয় ঘটিয়ে এটি কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর বর্তমান অবস্থা ও রোগের পর্যায় সম্পর্কে সঠিক তথ্য সরবরাহ করে যথাযথ চিকিত্সা প্রদানে ডাক্তারদের সহায়তা করে থাকে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বেগবান করা এ কারণেও জরুরি যে, একটি নতুন ওষুধ বাজারে ছাড়তে হলে আইডিয়া সৃষ্টি থেকে শুরু করে গবেষণা পরিচালনার পর ওষুধটি ব্যবহারের উপযোগী পর্যায়ে আনতে সময় লাগে অনেক বছর এবং খরচও হয় প্রচুর—দুই থেকে তিন মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থতা তো আছেই)। কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি, করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের ওষুধ যদি আবিষ্কার করা সম্ভবও হয়, তাহলেও সময়গত প্রতিবন্ধকতার কারণে আমাদের এমন কিছু বিকল্পের ওপর নির্ভর করতে হবে যার জন্য সময়ের প্রয়োজন হবে না। চীনে হুবেই শহর ছাড়াও অন্যান্য আক্রান্ত স্থানে প্রচুর সংখ্যায় করোনা ভাইরাসের প্রসার নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রচুর সংখ্যায় রোবট ব্যবহার করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। অধ্যাপক ইয়ঙ যখন হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন, তখন তিনিও খাবার পেতেন রোবটের মাধ্যমে। তাকে খাবার সরবরাহকারী রোবটটি নিজে নিজে লিফটে উঠতে-নামতে পারে, যে কোনো রুমের কাছে গিয়ে কলবেল টিপে রুমে ঢুকতে পারে। হসপিটালে মানুষের পরিবর্তে ডিসইনফেকশন রোবট ব্যবহার করা হয়েছে, যা মানুষ করতে পারে অনেক সময় এবং ভয় নিয়ে, রোবট তা অল্প সময়েই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছে নির্দ্বিধায়। চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্স একটি প্রোটোটাইপ রোবট বানিয়েছে, যা দিয়ে টেস্ট করার জন্য রিমোটলি রোগীর oropharyngeal swabs সংগ্রহ করছে যার ফলে চিকিত্সক বা চিকিত্সাকর্মীকে সরাসরি রোগীর কাছে গিয়ে ‘সোয়াব’ নিতে হয় না।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করে বিভিন্ন দেশের এমন পাঁচটি ওষুধ আবিষ্কারক কোম্পানি করোনা ভাইরাস নির্ণয়ে এবং চিকিত্সায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে। একই সঙ্গে ‘মেডিকেল রোবোটিকস কমিউনিটি’ করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে বেশ মাথা ঘামাচ্ছে। চীনের সাংহাই জিয়াও টং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল রোবোটিকসের প্রফেসর গুয়াং ঝং ইয়াং (যিনি বিশ্বব্যাপী মেডিক্যাল রোবোটির গুরু হিসেবে পরিচিত) বিদেশ থেকে প্রত্যাগত হওয়ার কারণে কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন এবং কোয়ারেন্টাইনে থাকার কারণে বাইরে যেতে পারেননি বটে কিন্তু হোটেলে থেকে হুবেই প্রদেশের করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রোবটের ব্যবহারের ওপর গবেষণা করেছেন এবং সাফল্যের সঙ্গে তার সহকর্মীদের সাহায্যে রোগীর জ্বর চেক করা, হসপিটাল জীবাণুমুক্ত করা এবং রোবটের সাহায্যে মেডিসিন আর খাবার ডেলিভারি দেওয়ার কাজ সম্পাদন করেছেন।
চীনকে দেখেও রাশিয়া ছাড়া ইউরোপের দেশগুলোসহ অন্যান্য দেশ পাত্তা দেয়নি। বিগত বছরের ৩০ ডিসেম্বর চীনের উহানে ভাইরাসটি শনাক্ত হওয়ার পরপরই রাশিয়া অতি দ্রুত ৩০ জানুয়ারি চীনের সঙ্গে ২ হাজার ৬০০ মাইল দীর্ঘ সীমান্ত বন্ধ করে দেয়; আক্রান্ত হওয়ার আগেই অনেকগুলো ‘কোয়ারেন্টাইন জোন’ প্রস্তুত করে রাখে। প্রথম থেকেই রোগী শনাক্তকরণ, সংক্রমিত রোগী যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে তাদের পরীক্ষা আর সামান্যতম লক্ষণ দেখা দিলেই পরীক্ষার ওপর জোর দেওয়াসহ সন্দেহযুক্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে রাখার ব্যবস্থা করেছে। যার ফলে ২৮ মার্চ পর্যন্ত মাত্র চার জন রাশিয়ান ভাইরাসের আক্রমণে মারা গিয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে মাত্র ১ হাজার ২৬৪ জন, যা ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই কম। ইতালি, স্পেন, জার্মানিসহ অন্যরা অপেক্ষা করছিল দেখার জন্য চীন কী করে, তারা কী করে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করে কিংবা পরিস্থিতি সামাল দেয় ইত্যাদি। আমরা বাংলাদেশের মানুষগুলো কি আমাদের চিন্তাচেতনাকে ধুয়েমুছে একটু বদলাতে পারব? বদলাতে পারলে টিকে থাকব, না বদলালে আমাদের নিয়তি প্রকৃতিই নির্ধারণ করে ফেলবে। ভুলে গেলে চলবে না, আরো অনেক রকমের ভাইরাস আসবে ভবিষ্যতে। অ্যান্টার্কটিকার হাজারো বছর ধরে জমে থাকা বরফের স্তূপ গলতে শুরু করেছে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আর গলে যাওয়া বরফ থেকে বেরিয়ে আসছে অনেক রকমের ভাইরাস। করোনার মতোই বিভিন্ন প্রাণী থেকেও জন্ম নেবে বহুবিধ ভাইরাস, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণে। পঙ্গপাল তো একটা আসন্ন বিপদ বলেই মনে হয়। প্রস্তুত থাকতে হবে আগেভাগেই। তাই আমাদের মন-মানসিকতা, চিন্তাভাবনা আর নৈতিকতার রূপান্তর ঘটানোর কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।
প্রফেসর ইয়ঙের একটি পরামর্শ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি ২০ মার্চ IEEE SPECTRUM-এর সঙ্গে একটি টেলিফোনিক কথোপকথনে বলেছেন, তিনটি পর্যায়ে কাজ করা দরকার। প্রথমত সরকারি পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ফান্ডিংয়ের বিষয়ে এবং একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কীভাবে প্ল্যান করা হবে এবং সবচেয়ে খারাপ অবস্থার জন্য কীভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে, সেসব বিষয়ে। দ্বিতীয় পর্যায়ে রোবটিকস কমিউনিটিতে নেতৃত্ব সৃষ্টি করে সচেতনতা তৈরি করতে হবে এবং সংক্রামক রোগের প্রতিকারের জন্য রোবটিকস চ্যালেঞ্জের মতো বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণার কাজ প্রমোট করতে হবে। স্বচালিত রোবট প্রযুক্তিতে চীন অনেক এগিয়েছে। তবে রোগীদের ফ্রন্টলাইন ম্যানেজমেন্টের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি (যেমন রোবটিক আইসিইউ) এখনো তেমন বিকশিত হয়নি, যা ভাইরাস ঠেকানোর মতো কাজে ব্যবহার করা যায়।
একটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার। মানুষ যখন আইসোলেশনে থাকে, তখন সে জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে মানসিক চাপের মধ্যে দিনাতিপাত করে। এক্ষেত্রে ‘সামাজিক রোবটিক’ কার্যক্রম বেশ সহায়ক হতে পারে। সামাজিক রোবটরা মানুষের সঙ্গে খেলাধুলা করতে পারবে, গল্প করতে পারবে এবং হাসি-তামাশাও করতে পারবে; সোজা কথায় মানুষের মতোই সঙ্গ দিতে পারবে। তাই মেডিক্যাল রোবটিকের পাশাপাশি সামাজিক রোবটিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করার কাজে হাত দেওয়া জরুরি। বিভিন্ন দেশের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষক আর বিশেষজ্ঞরা মিলে যৌথভাবে প্রচেষ্টা চালালে সফলতা আসবেই। গবেষণার দুয়ার খুলে দেওয়ার এখনই শ্রেষ্ঠ সময়। বৈশ্বিক মহাদুর্যোগই বিশ্বের সব দেশের শ্রেষ্ঠ গবেষকদের একত্রিত করবে এক ছাতার নিচে, যদি ইতিবাচক-আক্রোশি নেতৃত্ব দেয় কোনো একটি দেশ। এ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার উদ্যোগে এরূপ নেতৃত্বে কি বাংলাদেশ থাকতে পারে না?
লেখক: অধ্যাপক ড. এম এ মাননান
কলামিস্ট; উপাচার্য,
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়