ঢাকা ০৮:১৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিএনপি ভোটে এলে জোটে লড়বে আওয়ামী লীগ

জাতীয় ডেস্কঃ

সাংবিধানিক সময়ের হিসাবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের এখনও পৌনে দুই বছর বাকি থাকলেও এনিয়ে এখন থেকেই আলোচনা শুরু হয়ে গেছে রাজনৈতিক অঙ্গণে। শুধু আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, নির্বাচন কার অধীনে, কখন, কীভাবে হবে- তা নিয়েও প্রধান দলগুলোর মধ্যে চলছে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, চলছে নিজ নিজ অবস্থানের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন। এমনকি একক না জোটগত নির্বাচন, এনিয়েও দল-জোটের অভ্যন্তরে তত্পরতা দেখা যাচ্ছে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে জোটগতভাবেই নেবে, এমনটিই দলটির সিদ্ধান্ত। এইচএম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিও (জাপা) নতুন জোট গঠনে তত্পর হয়ে উঠেছে। যার কারণে রাজনৈতিক মহলে এখন যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে-তা হলো আওয়ামী লীগ তাহলে কী করবে? একক না জোটগতভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে ক্ষমতাসীন দলটি?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এবং বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পেতে ইত্তেফাক কথা বলেছে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সঙ্গে। আলাপ হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের একাধিক শরিক দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গেও। আলাপকালে তারা কিছু তথ্য প্রকাশে সম্মতি দিয়েছেন, কিছু কথা প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন। প্রকাশে সম্মতি-অসম্মতি পাওয়া তথ্যেসমূহের পর্যালোচনায় যে বার্তাটি পরিস্কার তা হচ্ছে, নির্বাচনে বিএনপির  আসা না আসার সিদ্ধান্তের উপরই অনেকটা নির্ভর করবে আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত কৌশল। বিএনপি নির্বাচনে এলে এক ধরনের কৌশল, না এলে ভিন্ন চিন্তা-ভাবনাও হতে পারে। বিএনপি শেষ পর্যন্ত জোটগতভাবে নির্বাচনে প্রতিযোগী হলে আওয়ামী লীগও নিজেদের বিদ্যমান জোট নিয়েই লড়বে- এই বার্তাও মিলেছে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আলাপচারিতায়। সঙ্গে আরেকটি বার্তাও পাওয়া গেল, বিএনপি ভোটের মাঠে খেলতে এলে ১৪ দল ঠিক রেখে জোটের পরিধি বৃদ্ধি করে বন্ধুবলয় বাড়ানোর পরিকল্পনাও রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের।

‘ধরে নিচ্ছি বিএনপি তাদের জোট ২০ দলকে নিয়েই নির্বাচনে আসবে, তাহলে সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কৌশল কী হবে?’ মঙ্গলবার রাতে আলাপকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে এ প্রশ্ন রাখা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের তো জোট আছে। আমরা তো জোট থেকে সরিনি, জোট তো করে যাচ্ছি। সারাবছর জোট করব, আর নির্বাচনের সময় করব না, একসঙ্গে নির্বাচন করব না-এমন সুবিধাবাদী দল তো আওয়ামী লীগ নয়। তারপরেও নির্বাচন এলে আবার কথা হবে, ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গেও আলোচনা হবে, নতুন বন্ধুদের সঙ্গেও কথা হতে পারে। জোটের কি রূপ দাঁড়াবে-সেটি আগামী বছরের শুরুর দিকে হয়তো পরিস্কার হবে।’

‘আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর আগামী নির্বাচন আপনার সামনে প্রথম নির্বাচন, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিএনপিসহ কতগুলো দলের ভিন্ন দাবি আছে, একইসঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকা জাপা নতুন জোট গঠনে তত্পরতা চালাচ্ছে….।’ এমন কথার পিঠে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে, প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো ম্যাচিউরড (পরিণত) হতে সময় লাগবে। আমাদের এখন ১৪ দল আছে, সরকারও ১৪ দলের, শরিকদের কয়েকজনও মন্ত্রিসভার সদস্য, এরশাদ সাহেবও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। এরশাদ সাহেব নতুন জোট করতে পারেন, সেটা ওনার দলের বিষয়। সামগ্রিক বিষয়গুলোর পরিণত রূপ দেখতে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।’

আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের শরিকদের অনেকেরই ধারণা, ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচন নয়’, ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন দিতে হবে’ কিংবা ‘প্রয়োজনে কেয়ামতের আগ পর্যন্ত শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাব না’- বিএনপি নেতারা এরকম নানা কথা বললেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো তারা আগামী নির্বাচন বর্জন করবে না। মুখে এখন যাই বলুক না কেন, আনুষঙ্গিক নানা কারণেই বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসবে বলেই ধরে নিচ্ছেন ক্ষমতাসীনেরা।

একেবারে স্পষ্ট করে না বললেও এমন সুর পাওয়া গেল আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর কণ্ঠেও। মঙ্গলবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে ইত্তেফাকের সঙ্গে বেশকিছু সময় আলাপকালে মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘আমার তো মনে হয়-বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে হবে। সারাবছর লেখাপড়া করে কেউ যদি পরীক্ষা না দেয়, তাহলে সে তো পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ হতে পারে না। রাজনীতি করব, অথচ জনগণের রায় নেব না-এটা তো হয় না। নির্বাচন বাদ দিয়ে গণভিত্তি বজায় রাখা সম্ভব নয়, এটা প্রমাণিত বাস্তবতা। ভারতেও যারা নির্বাচন বাদ দিয়েছে তারা কিন্তু টিকে নাই।’

‘আপনার কথামতে গণভিত্তি ধরে রাখতে বিএনপি যদি আগামী নির্বাচনে আসে তাহলে আওয়ামী লীগ কি একক না জোট নিয়ে লড়বে?’ মতিয়া চৌধুরীর জবাব, ‘বিএনপি নির্বাচনে আসলে ভালো কথা। আমরা তো জোট ভেঙ্গে দিইনি, বরং যথেষ্ঠ কেয়ার (যত্ন) নিয়ে আমরা একে অপরের হাত ধরে কাজ করে যাচ্ছি। আর বিএনপির জোট তো সবসময় হয়েই থাকে, যারা স্বাধীনতাবিরোধী ও সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদে জড়িত তাদের সঙ্গে তো বিএনপির আঁতাত এমনিতেই থাকে। তবে আমরা এটা বলতে পারি, যারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি তাদের জন্য আওয়ামী লীগের জোটের দরজা খোলা, তাদের সঙ্গে সমঝোতা হতে পারে। আর যারা স্বাধীনতা বিরোধীদের টুল দেওয়ার জন্য তত্পর, তাদের সঙ্গে আপস হবে না।’

‘আওয়ামী লীগের জোটের পরিধি বাড়ানোর যে চিন্তা-ভাবনার সূত্র আপনার কথায় পেলাম, সেটা আরেকটু ব্যাখ্যা করবেন?’ এমন প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘কার্ডিনাল (প্রধান) পয়েন্ট তো একটা, সেটা হলো স্বাধীনতা। মূল জায়গাটিকে ঠিক রেখে বহু মত-পথের সমন্বয় ঘটাতে আওয়ামী লীগ সবসময়ই চেষ্টা করে। স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থানে থাকা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করা-এগুলো আওয়ামী লীগের বিউটি (সৌন্দর্য্য)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বহুমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আওয়ামী লীগের বাইরেও যারা বাংলাদেশের পক্ষে ভালো চিন্তা-ভাবনা করেন, তাদের সবাইকে নিয়েই তিনি (প্রধানমন্ত্রী) চলতে চান, তার চিন্তা-ভাবনা অনেক বিস্তৃত।’

আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে না-কি জোট নিয়ে লড়বে, এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, ১৪ দলের সমন্বয়ক এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম আরও আগে থেকে প্রকাশ্যেই বার্তা দিয়ে আসছেন। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর রাজধানীতে ১৪ দল শরিক জাতীয় পার্টি-জেপি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় মোহাম্মদ নাসিম বলেছিলেন, ‘১৪ দল একসঙ্গে আছে, একসঙ্গেই থাকবে, আমরা একসঙ্গে লড়াই-সংগ্রাম করেছি এবং করছি। আগামীতেও ১৪ দল একসঙ্গে নির্বাচন করবে, খোদা চায় তো একত্রে সরকারও গঠন করতে পারে। কারণ একই লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ১৪ দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছে।’

এ তো গেল ১৪ দলের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের নেতাদের কথা। আগামী নির্বাচন নিয়ে ১৪ দলের শরিকরা কি ভাবছেন?  তাদের ভাবনা জানতে গতকাল বুধবার আলাপ হয় ১৪ দল শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি সভাপতি এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের সঙ্গে। তিনি ইত্তেফাককে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমাদের যেটি বলা হয়েছে, জোটের পরিধি কিছুটা বাড়তে পারে। আমরা তো জোটবদ্ধ নির্বাচনেরই পক্ষে, বাকিটা নির্ভর করবে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের উপর।’

‘কোন দলগুলোর কথা মাথায় রেখে এই চিন্তা-ভাবনা?’ এ প্রশ্নের জবাবে মেনন বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট করে কোনো দলের নাম বলতে পারবো না। যারা ১৪ দলের লক্ষ্য-আদর্শ ধারণ করে, এরকম কেউ আসতে চাইলে তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হবে।’

একই বিষয়ে ১৪ দলের আরেক শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ (ইনু) সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের নির্মূল করতে ১৪ দলকে আমরা আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করতে কাজ করছি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু দল এখনও আমাদের জোটের বাইরে রয়েছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই আলোচনা হতে পারে। ১৪ দলের চেতনায় বিশ্বাসী কেউ যদি আমাদের জোটে আসে আমরা তাকে স্বাগত জানাবো।’

এরশাদের সম্ভাব্য জোটের দিকেও চোখ রাখছে আওয়ামী লীগ : বিএনপি আগামী নির্বাচনে আসছে-এরকম ধরে নিয়ে নতুন করে তত্পর হয়ে উঠেছে এরশাদের জাপা। বিএনপি নির্বাচনে এলে আগামীতে রাজনীতি ও সংসদে নিজেদের অবস্থান নিয়ে নানামুখী ভাবনায় পড়েছে দলটি। এই ভাবনা থেকেই নতুন রাজনৈতিক জোট গঠনের তোড়জোড় শুরু করেছে দলটি।

জোট গঠনের লক্ষ্যে জাপা চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, আমজনতা পার্টি, গণতান্ত্রিক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ইসলামী ডেমোক্রেটিক পার্টি, কৃষক শ্রমিক পার্টি, ইউনাইটেড মুসলিম লীগ, গণ-অধিকার পার্টি, তফসিল ফেডারেশন, জাতীয় হিন্দু লীগ, সচেতন হিন্দু পার্টি, বাংলাদেশ পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিপিডিপি) ও ইসলামী গণ-আন্দোলনসহ দু’তিনটি নিবন্ধিত ও প্রায় ১৫টির মত অনিবন্ধিত দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। জোটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আগামী শনিবার দলের প্রেসিডিয়াম বৈঠক ডেকেছেন এরশাদ। সম্ভাব্য এই জোট সম্পর্কে জাপা মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘জোট গঠনের বিষয়টি সক্রিয় প্রক্রিয়াধীন। চলতি মাসেই অথবা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এর ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।’

এরশাদের সম্ভাব্য এই জোটের দিকে যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চোখ রাখছে সেটি বোঝা যায় আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের ও বেগম মতিয়া চৌধুরীর মন্তব্যে। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এরশাদ সাহেব তো আলাদা জোট করতেই পারেন, সেটা তো তার দলের বিষয়। তবে দেখা যাক, কি হয়।’ আর মতিয়া চৌধুরীর মন্তব্য, ‘এরশাদ সাহেব জোট করছেন-এরকম পত্রিকায় পড়েছি, জোট করার রাইট্স (অধিকার) তো তার আছে।’

ইত্তেফাক/

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

বিএনপি ভোটে এলে জোটে লড়বে আওয়ামী লীগ

আপডেট সময় ০৪:১২:৫২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ ২০১৭
জাতীয় ডেস্কঃ

সাংবিধানিক সময়ের হিসাবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের এখনও পৌনে দুই বছর বাকি থাকলেও এনিয়ে এখন থেকেই আলোচনা শুরু হয়ে গেছে রাজনৈতিক অঙ্গণে। শুধু আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, নির্বাচন কার অধীনে, কখন, কীভাবে হবে- তা নিয়েও প্রধান দলগুলোর মধ্যে চলছে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, চলছে নিজ নিজ অবস্থানের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন। এমনকি একক না জোটগত নির্বাচন, এনিয়েও দল-জোটের অভ্যন্তরে তত্পরতা দেখা যাচ্ছে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে জোটগতভাবেই নেবে, এমনটিই দলটির সিদ্ধান্ত। এইচএম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিও (জাপা) নতুন জোট গঠনে তত্পর হয়ে উঠেছে। যার কারণে রাজনৈতিক মহলে এখন যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে-তা হলো আওয়ামী লীগ তাহলে কী করবে? একক না জোটগতভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে ক্ষমতাসীন দলটি?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এবং বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পেতে ইত্তেফাক কথা বলেছে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সঙ্গে। আলাপ হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের একাধিক শরিক দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গেও। আলাপকালে তারা কিছু তথ্য প্রকাশে সম্মতি দিয়েছেন, কিছু কথা প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন। প্রকাশে সম্মতি-অসম্মতি পাওয়া তথ্যেসমূহের পর্যালোচনায় যে বার্তাটি পরিস্কার তা হচ্ছে, নির্বাচনে বিএনপির  আসা না আসার সিদ্ধান্তের উপরই অনেকটা নির্ভর করবে আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত কৌশল। বিএনপি নির্বাচনে এলে এক ধরনের কৌশল, না এলে ভিন্ন চিন্তা-ভাবনাও হতে পারে। বিএনপি শেষ পর্যন্ত জোটগতভাবে নির্বাচনে প্রতিযোগী হলে আওয়ামী লীগও নিজেদের বিদ্যমান জোট নিয়েই লড়বে- এই বার্তাও মিলেছে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আলাপচারিতায়। সঙ্গে আরেকটি বার্তাও পাওয়া গেল, বিএনপি ভোটের মাঠে খেলতে এলে ১৪ দল ঠিক রেখে জোটের পরিধি বৃদ্ধি করে বন্ধুবলয় বাড়ানোর পরিকল্পনাও রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের।

‘ধরে নিচ্ছি বিএনপি তাদের জোট ২০ দলকে নিয়েই নির্বাচনে আসবে, তাহলে সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কৌশল কী হবে?’ মঙ্গলবার রাতে আলাপকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে এ প্রশ্ন রাখা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের তো জোট আছে। আমরা তো জোট থেকে সরিনি, জোট তো করে যাচ্ছি। সারাবছর জোট করব, আর নির্বাচনের সময় করব না, একসঙ্গে নির্বাচন করব না-এমন সুবিধাবাদী দল তো আওয়ামী লীগ নয়। তারপরেও নির্বাচন এলে আবার কথা হবে, ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গেও আলোচনা হবে, নতুন বন্ধুদের সঙ্গেও কথা হতে পারে। জোটের কি রূপ দাঁড়াবে-সেটি আগামী বছরের শুরুর দিকে হয়তো পরিস্কার হবে।’

‘আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর আগামী নির্বাচন আপনার সামনে প্রথম নির্বাচন, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিএনপিসহ কতগুলো দলের ভিন্ন দাবি আছে, একইসঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকা জাপা নতুন জোট গঠনে তত্পরতা চালাচ্ছে….।’ এমন কথার পিঠে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে, প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো ম্যাচিউরড (পরিণত) হতে সময় লাগবে। আমাদের এখন ১৪ দল আছে, সরকারও ১৪ দলের, শরিকদের কয়েকজনও মন্ত্রিসভার সদস্য, এরশাদ সাহেবও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। এরশাদ সাহেব নতুন জোট করতে পারেন, সেটা ওনার দলের বিষয়। সামগ্রিক বিষয়গুলোর পরিণত রূপ দেখতে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।’

আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের শরিকদের অনেকেরই ধারণা, ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচন নয়’, ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন দিতে হবে’ কিংবা ‘প্রয়োজনে কেয়ামতের আগ পর্যন্ত শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাব না’- বিএনপি নেতারা এরকম নানা কথা বললেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো তারা আগামী নির্বাচন বর্জন করবে না। মুখে এখন যাই বলুক না কেন, আনুষঙ্গিক নানা কারণেই বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসবে বলেই ধরে নিচ্ছেন ক্ষমতাসীনেরা।

একেবারে স্পষ্ট করে না বললেও এমন সুর পাওয়া গেল আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর কণ্ঠেও। মঙ্গলবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে ইত্তেফাকের সঙ্গে বেশকিছু সময় আলাপকালে মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘আমার তো মনে হয়-বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে হবে। সারাবছর লেখাপড়া করে কেউ যদি পরীক্ষা না দেয়, তাহলে সে তো পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ হতে পারে না। রাজনীতি করব, অথচ জনগণের রায় নেব না-এটা তো হয় না। নির্বাচন বাদ দিয়ে গণভিত্তি বজায় রাখা সম্ভব নয়, এটা প্রমাণিত বাস্তবতা। ভারতেও যারা নির্বাচন বাদ দিয়েছে তারা কিন্তু টিকে নাই।’

‘আপনার কথামতে গণভিত্তি ধরে রাখতে বিএনপি যদি আগামী নির্বাচনে আসে তাহলে আওয়ামী লীগ কি একক না জোট নিয়ে লড়বে?’ মতিয়া চৌধুরীর জবাব, ‘বিএনপি নির্বাচনে আসলে ভালো কথা। আমরা তো জোট ভেঙ্গে দিইনি, বরং যথেষ্ঠ কেয়ার (যত্ন) নিয়ে আমরা একে অপরের হাত ধরে কাজ করে যাচ্ছি। আর বিএনপির জোট তো সবসময় হয়েই থাকে, যারা স্বাধীনতাবিরোধী ও সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদে জড়িত তাদের সঙ্গে তো বিএনপির আঁতাত এমনিতেই থাকে। তবে আমরা এটা বলতে পারি, যারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি তাদের জন্য আওয়ামী লীগের জোটের দরজা খোলা, তাদের সঙ্গে সমঝোতা হতে পারে। আর যারা স্বাধীনতা বিরোধীদের টুল দেওয়ার জন্য তত্পর, তাদের সঙ্গে আপস হবে না।’

‘আওয়ামী লীগের জোটের পরিধি বাড়ানোর যে চিন্তা-ভাবনার সূত্র আপনার কথায় পেলাম, সেটা আরেকটু ব্যাখ্যা করবেন?’ এমন প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘কার্ডিনাল (প্রধান) পয়েন্ট তো একটা, সেটা হলো স্বাধীনতা। মূল জায়গাটিকে ঠিক রেখে বহু মত-পথের সমন্বয় ঘটাতে আওয়ামী লীগ সবসময়ই চেষ্টা করে। স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থানে থাকা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করা-এগুলো আওয়ামী লীগের বিউটি (সৌন্দর্য্য)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বহুমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আওয়ামী লীগের বাইরেও যারা বাংলাদেশের পক্ষে ভালো চিন্তা-ভাবনা করেন, তাদের সবাইকে নিয়েই তিনি (প্রধানমন্ত্রী) চলতে চান, তার চিন্তা-ভাবনা অনেক বিস্তৃত।’

আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে না-কি জোট নিয়ে লড়বে, এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, ১৪ দলের সমন্বয়ক এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম আরও আগে থেকে প্রকাশ্যেই বার্তা দিয়ে আসছেন। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর রাজধানীতে ১৪ দল শরিক জাতীয় পার্টি-জেপি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় মোহাম্মদ নাসিম বলেছিলেন, ‘১৪ দল একসঙ্গে আছে, একসঙ্গেই থাকবে, আমরা একসঙ্গে লড়াই-সংগ্রাম করেছি এবং করছি। আগামীতেও ১৪ দল একসঙ্গে নির্বাচন করবে, খোদা চায় তো একত্রে সরকারও গঠন করতে পারে। কারণ একই লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ১৪ দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছে।’

এ তো গেল ১৪ দলের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের নেতাদের কথা। আগামী নির্বাচন নিয়ে ১৪ দলের শরিকরা কি ভাবছেন?  তাদের ভাবনা জানতে গতকাল বুধবার আলাপ হয় ১৪ দল শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি সভাপতি এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের সঙ্গে। তিনি ইত্তেফাককে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমাদের যেটি বলা হয়েছে, জোটের পরিধি কিছুটা বাড়তে পারে। আমরা তো জোটবদ্ধ নির্বাচনেরই পক্ষে, বাকিটা নির্ভর করবে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের উপর।’

‘কোন দলগুলোর কথা মাথায় রেখে এই চিন্তা-ভাবনা?’ এ প্রশ্নের জবাবে মেনন বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট করে কোনো দলের নাম বলতে পারবো না। যারা ১৪ দলের লক্ষ্য-আদর্শ ধারণ করে, এরকম কেউ আসতে চাইলে তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হবে।’

একই বিষয়ে ১৪ দলের আরেক শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ (ইনু) সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের নির্মূল করতে ১৪ দলকে আমরা আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করতে কাজ করছি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু দল এখনও আমাদের জোটের বাইরে রয়েছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই আলোচনা হতে পারে। ১৪ দলের চেতনায় বিশ্বাসী কেউ যদি আমাদের জোটে আসে আমরা তাকে স্বাগত জানাবো।’

এরশাদের সম্ভাব্য জোটের দিকেও চোখ রাখছে আওয়ামী লীগ : বিএনপি আগামী নির্বাচনে আসছে-এরকম ধরে নিয়ে নতুন করে তত্পর হয়ে উঠেছে এরশাদের জাপা। বিএনপি নির্বাচনে এলে আগামীতে রাজনীতি ও সংসদে নিজেদের অবস্থান নিয়ে নানামুখী ভাবনায় পড়েছে দলটি। এই ভাবনা থেকেই নতুন রাজনৈতিক জোট গঠনের তোড়জোড় শুরু করেছে দলটি।

জোট গঠনের লক্ষ্যে জাপা চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, আমজনতা পার্টি, গণতান্ত্রিক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ইসলামী ডেমোক্রেটিক পার্টি, কৃষক শ্রমিক পার্টি, ইউনাইটেড মুসলিম লীগ, গণ-অধিকার পার্টি, তফসিল ফেডারেশন, জাতীয় হিন্দু লীগ, সচেতন হিন্দু পার্টি, বাংলাদেশ পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিপিডিপি) ও ইসলামী গণ-আন্দোলনসহ দু’তিনটি নিবন্ধিত ও প্রায় ১৫টির মত অনিবন্ধিত দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। জোটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আগামী শনিবার দলের প্রেসিডিয়াম বৈঠক ডেকেছেন এরশাদ। সম্ভাব্য এই জোট সম্পর্কে জাপা মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘জোট গঠনের বিষয়টি সক্রিয় প্রক্রিয়াধীন। চলতি মাসেই অথবা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এর ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।’

এরশাদের সম্ভাব্য এই জোটের দিকে যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চোখ রাখছে সেটি বোঝা যায় আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের ও বেগম মতিয়া চৌধুরীর মন্তব্যে। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এরশাদ সাহেব তো আলাদা জোট করতেই পারেন, সেটা তো তার দলের বিষয়। তবে দেখা যাক, কি হয়।’ আর মতিয়া চৌধুরীর মন্তব্য, ‘এরশাদ সাহেব জোট করছেন-এরকম পত্রিকায় পড়েছি, জোট করার রাইট্স (অধিকার) তো তার আছে।’

ইত্তেফাক/