ধর্ম ও জীবন ডেস্কঃ
নবী-রাসূল কিংবা অলী-আউলিয়াগণ প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনার অবতারণা করেছেন, স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেসব ঘটনা একদমই অলৌকিক। নবী-রাসূলগণ যখন এ ধরনের ঘটনার অবতারণা করেন, তখন তাকে বলে মুজিযা। একইরকম ঘটনার অবতারণা যখন কোনো অলী-আউলিয়া করেন, তখন তাকে বলে কারামত। সিলেটের হযরত শাহজালাল (র:) সম্পর্কেও বেশ কিছু অলৌকিক ঘটনা প্রচলিত আছে। সেসব ঘটনা মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এগুলোর মাঝে কিছু কিছু গ্রন্থিত হয়ে বই আকারে প্রকাশও হয়েছে।
বিষ যেভাবে শরবত হয়ে গেলো…
যখন শুনলেন হযরত শাহজালাল (র:) ইয়েমেনে আসছেন তখন তার ইচ্ছে হলো হযরত শাহজালাল (র:)-এর আধ্যাত্মিকতার গভীরতা কতটুকু তা একটু পরীক্ষা করে দেখবেন। সে উদ্দেশ্যে তিনি হযরত শাহজালাল (র:) এবং তার সাথীদেরকে রাজদরবারের মেহমান হিসেবে আমন্ত্রণ করেন। তারা উপস্থিত হলে তাদেরকে শরবত পরিবেশন করা হয়। হযরত শাহজালাল (র:)-কে পরীক্ষা করার জন্য তিনি শরবতের মাঝে বিষ মিশিয়ে রেখেছিলেন।
ইসলামের নিয়ম অনুসারে, খাবারের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলতে হয় এবং এই বাক্যের অনেক অলৌকিক গুণ আছে। তারা সকলে বিসমিল্লাহ বলে সেই শরবত পান করলেন এবং সকলেই নিরাপদ রইলেন। উপরন্তু বিষহীন সাধারণ শরবত পান করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন বাদশাহ। খোদার লীলাখেলা বোঝা বড়ই কঠিন। বিষ হয়ে যায় শরবত আর শরবত হয়ে যায় বিষ। এ ঘটনা দেখে ভীত হয়ে বাদশাহর পুত্র সিংহাসন ছেড়ে দিয়ে হযরত শাহজালাল (র:)-এর সাথে সাথী হয়ে চলে আসেন।
দরগাহের পুকুরের সাথে যমযম কূপের সংযোগ…
তখনকার সময় খাবার পানি এখনকার মতো সহজলভ্য ছিল না। এখন নলকূপ আছে, ফিল্টারকরণ পদ্ধতি আছে, তখন এসবের কিছুই ছিল না। সরাসরি নদী থেকেই পানি পান করতে হতো মানুষদেরকে। সিলেট অঞ্চলে পানির অন্যতম উৎস এই সুরমা নদী। কিন্তু এর পানি ঘোলা। পানি ঘোলা মানে এটি দূষিত, এখানের পানি পান করলে মানুষ অসুস্থ হয়ে যাবে। তাই অফুরন্ত একটি উৎস থাকা সত্ত্বেও মানুষ এর পানি পান করতে পারছে না। পানযোগ্য পানির পিপাসায় দিন পার করছে।
এমন পরিস্থিতিতে এলাকাবাসী সকলে গেলো সে অঞ্চলের সেরা বুজুর্গ ব্যক্তি হযরত শাহজালাল (র:)-এর কাছে। তিনি সব শুনে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করলেন যেন সিলেটবাসীর পানির কষ্ট দূর হয়ে যায়। শুধু দূরই নয়, সবচেয়ে সেরা মানের পানি যেন তারা পায় এ দোয়াও করলেন। তিনি আল্লাহর কাছে চাইলেন মক্কার যমযম কূপের সাথে যেন সিলেটের পানির সংযোগ হয়ে যায়। ফলে সিলেটের মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পানীয় পান করার সুযোগ পাবে।
আল্লাহ তার দোয়া কবুল করে নিলেন। যখন তার মোনাজাত শেষ হলো তখন একটি গায়েবী আওয়াজ (অদৃশ্য শব্দ) ভেসে এলো। কেউ একজন হযরত শাহজালাল (র:)-কে বলছে, এ স্থানে যেন একটি কূপ খনন করে। সবাই মিলে তার দরবারের পাশে একটি কূপ খনন করলো। এরপর একদিন শুক্রবার এলো। বেশ কয়েকজন ভক্ত-অনুসারী নিয়ে তিনি কূপের কাছে গেলেন। তার হাতে ছিল একটি লাঠি। কূপে আঘাত করার জন্য সেই লাঠি তিনি উঁচিয়ে ধরলেন। আঘাত করা মাত্র গায়েবীভাবে নীচ থেকে পানি আসতে শুরু করলো। শুধু পানিই নয়, পানির সাথে করে রং-বেরংয়ের মাগুর, কৈ প্রভৃতি মাছও আসতে শুরু করলো। সে মাছের বংশধরদের এখনো দেখতে পাওয়া যায়। দর্শনার্থীরা আদর করে অনেক কিছু খেতে দেয় তাদের।
হযরত শাহজালাল (র:) আল্লাহর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন এর সাথে যেন মক্কার যমযম কূপের সংযোগ স্থাপিত হয়, হলোও তা। এর পানি যমযমের মতোই স্বচ্ছ এবং সুস্বাদু। লাঠির আঘাতে সিলেটের কূপের সাথে মিলন ঘটে সুদূর মক্কার যমযম কূপের।
পরবর্তীতে একসময় ঐ কূপটির চারপাশ পাকা করে দেয়া হয়। একদিকে দুটি পাথর বসিয়ে দেয়া হয় যা থেকে সবসময় পানি প্রবাহিত হয়। পানীয় হিসেবে পান করার গণ্ডি ছাড়িয়ে এটি এখন অনেক কাজে ব্যবহার করা হয়। হযরত শাহজালাল (র:)-এর ভক্তদের বিশ্বাস, এই কূপের পানি পান করলে অনেক রোগ ভালো হয়ে যায়। এমনও প্রচলিত আছে, অনেক ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েও ভালো হয়নি এমন দুরারোগ্য ব্যাধীও সেরেছে এখানের অলৌকিক পানি পান করার পর। দরগাহে অনেকে নিয়মিত থাকেন, তাদের অনেকে রোজা রাখেন। সেসব রোজাদারেরা এখানের পানি পান করে ইফতার করেন।
রোগ ভালো হওয়া সহ প্রভূত উপকার পাওয়া যায় বলে অনেকে এখানের পানি বোতলে ভরে নিয়ে আসেন। কেউ কেউ এ পানি বিক্রিও করেন। হযরত শাহজালাল (র:)-এর ভক্তরা বোতল ভর্তি সেসব পানি টাকা দিয়ে কিনেনও। শোনা যায়, ওষুধ হিসেবে পানি পান করে অনেকেই আরোগ্য লাভ করেন এবং অন্য কোনো উদ্দেশ্যে পান করলেও সে উদ্দেশ্য পূরণ হয়।
দরগাহের পুকুরে বাটিভর্তি স্বর্ণমুদ্রা…
তৎকালে লেনদেনের জন্য স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন ছিল। আর সে সময় এখনকার মতো আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। কেউ হজ্ব করতে গেলে মাসের পর মাস পায়ে হেঁটে যেতে হতো। এতে অনেকদিন সময় তো লাগতোই, পাশাপাশি পথে পথে ওৎ পেতে থাকতো চোর-ডাকাত আর বিপদ-আপদ। সিলেটের চান্দাইটিলা গ্রামে আব্দুল মনসুর ও আব্দুল ওহাব নামে দুজন ব্যক্তি বসবাস করতেন। তারা একবার হজ্বের উদ্দেশ্যে মক্কায় গমন করলেন। ঠিকমতো হজ্ব সম্পন্নও করলেন। যখন ফিরে আসার সময় হলো, তখন তারা দেখতে পেলেন তাদের কাছে বেশ কিছু স্বর্ণমুদ্রা অবশিষ্ট রয়েছে। ফিরে আসতে হলে এত পরিমাণ মুদ্রার প্রয়োজন পড়বে না। তাই এগুলো নিয়ে তাদের মাঝে বেশ চিন্তার জন্ম হলো। পায়ে হেঁটে কিংবা উটে চড়ে আসতে হবে এতটা রাস্তা, পদে পদে আছে ডাকাতের উৎপাত, মুদ্রাগুলো যেকোনো সময় ছিনতাই হয়ে যেতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে তারা চমৎকার একটি বিষয় সম্বন্ধে ভাবলেন। হযরত শাহজালাল (র:)-এর মাজারের পাশে একটি পুকুর আছে। হযরত শাহজালাল (র:)-এর ভক্তদের মাঝে প্রচলিত আছে যে, এখানের পুকুরের সাথে যমযম কূপের সংযোগ বিদ্যমান। এখানের পানি পান করা মানে যমযম কূপের পানি পান করা। এই বিশ্বাস থেকে দুজন ভাবলেন, যমযম কূপে যদি স্বর্ণমুদ্রাগুলোকে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে সেগুলো নিশ্চয় হযরত শাহজালাল (র:)-এর মাজারের পুকুরে গিয়ে উপস্থিত হবে। যদি এই পদ্ধতিতে মুদ্রাগুলোকে বাসস্থান সিলেটে পাঠানো যায় তাহলে নিশ্চিন্তে ও নির্ভয়ে পাড়ি দেয়া যাবে বিপদসঙ্কুল পথ।
চমকপ্রদ এই ভাবনায় দুজন সম্মত হয়ে যাত্রাপথের জন্য অল্প কিছু স্বর্ণমুদ্রা রেখে বাকিগুলোকে একটি বাটিতে প্যাকেট করে ছেড়ে দেন যমযম কূপে। মুদ্রার সাথে নিজেদের নাম ঠিকানাও লিখে দেন। আল্লাহর নামে সেগুলোকে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে পথ পাড়ি দিয়ে উপস্থিত হন বাসভূমি সিলেটে। মক্কা নগরী থেকে সিলেটে পৌঁছাতে তাদের দুই মাস সময় লেগে যায়।
তবে তাদের পৌঁছানোর আগেই হযরত শাহজালাল (র:)-এর দরগাহে পৌঁছে যায় তাদের সেই স্বর্ণমুদ্রার বাটি। দরগাহের খাদেম একদিন পুকুর পরিষ্কার করতে এসে এই বাটিটি পান। এটি খুলে দেখেন এর ভেতরে সিলেটের একটি ঠিকানা এবং বেশ কিছু স্বর্ণমুদ্রা। নিশ্চয় কোনো অলৌকিক কিছু হয়ে থাকবে মনে করে তিনি বাটিটি যত্ন সহকারে রেখে দেন।
একসময় হজ্বযাত্রী দুজন সিলেটে পৌঁছায় এবং হযরত শাহজালাল (র:)-এর দরগাহে এসে খাদেমকে ঘটনা বলে। সবকিছু শুনে খাদেম তাদেরকে সেই পাওয়া বাটিটি তাদের হাতে দেয় এবং দেখা যায় মক্কায় ছেড়ে দেয়া সেই বাটিটিই এখানে এসে উপস্থিত হয়ে আছে। এ ঘটনায় তিনি হযরত শাহজালাল (র:)-এর আধ্যাত্মিকতা ও অলৌকিকতার গভীরতা অনুভব করতে পারেন। সহি-সালামতে নিজের স্বর্ণমুদ্রা ফিরে পাওয়ায় বাড়ি যাবার আগে সেখান থেকে দুটি স্বর্ণমুদ্রা মাজারে দান করে যান।
জ্বলন্ত আগুন যখন সুস্বাদু খাদ্য…
হযরত শাহজালাল (র:) যখন নিজ দেশ থেকে সিলেটে আগমন করেন, তখন যাত্রাকালে কিছুদিন ভারতের দিল্লিতে অবস্থান করেন। সে সময় ঐ অঞ্চলে বাস করতেন হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া (র:)। তিনিও একজন জগদ্বিখ্যাত পীর। সেখানে তার অনেক ভক্ত ছিল। হযরত শাহজালাল (র:) তার আস্তানায় আসা যাওয়া করতে লাগলেন। একদিন এক ভক্ত হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া (র:)-এর কাছে গিয়ে বললেন তাদের আস্তানায় একজন লোক এসেছেন। এ লোকের আধ্যাত্মিক শক্তি বেশ প্রবল এবং তার সংস্পর্শে আসলে দিল ঠাণ্ডা হয়ে যায়, মনের দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়। অজানা জিনিসের ব্যাপারে তিনি না দেখেই বলে দিতে পারেন।
এ কথা শুনে হযরত নিজামউদ্দীন আউলিয়া (র:)-এর ইচ্ছে হলো হযরত শাহজালাল (র:)-এর আধ্যাত্মিক শক্তি কতটুকু তা পরীক্ষা করে দেখবেন। সে লক্ষ্যে কিছু রুটি ও কিছু আগুন নিলেন। আগুনকে রুটির মধ্যে ভরে জড়িয়ে নিলেন। তারপর একটি কৌটায় করে খাবার জন্য পাঠালেন হযরত শাহজালাল (র:)-এর নিকট। এদিকে হযরত শাহজালাল (র:) না দেখেই জেনে গিয়েছিলেন এর ভেতরে কী আছে। কিন্তু তিনি এ সম্পর্কে কিছু বললেন না। কারণ বলে দেবার চেয়েও আরো বড় চমক অপেক্ষা করছে। রুটির কৌটাটি খুলে খেতে শুরু করলেন আগুনের টুকরোগুলোকে। কিন্তু অলৌকিকভাবে এ আগুন কিছুই করতে পারলো না হযরত শাহজালাল (র:)-কে। অলৌকিকভাবে আগুনগুলো সুস্বাদু খাদ্যে পরিণত হয়ে গেল।
এ ঘটনায় হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া বুঝতে পারেন হযরত শাহজালাল (র:)-এর আসলেই অনেক আধ্যাত্মিক জ্ঞান আছে। তিনি তার ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে যান। দ্রুত তার আস্তানায় গিয়ে সাক্ষাৎ লাভ করেন এবং সম্মানের নিদর্শনস্বরূপ এক জোড়া কবুতর উপহার করেন। হযরত শাহজালালও এই কবুতর জোড়াকে আদরের সাথে সিলেটে নিয়ে আসেন। এই কবুতরগুলোই পরবর্তীতে বংশবৃদ্ধি করে এবং ছড়িয়ে পড়ে। জালালী কবুতর হিসেবে যে কবুতর প্রকরণকে চিনি তারা মূলত ঐ দুই কবুতরেরই বংশধর।