জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবনে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের প্রভাব, লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি ও খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় পিটিয়ে হত্যাসহ ক্রমাগত বাঘ হত্যার ঘটনা বাড়ছে। গত ৪১ বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানুষের কারণে ১৪৫টি বাঘ হত্যা বা মৃতের ঘটনা ঘটে। এদিকে নির্বিচারে বাঘ হত্যার ঘটনায় বাঘের অস্তিত্ব নিয়ে বাঘ বিশেষজ্ঞ ও প্রাণিবিজ্ঞানীরা শঙ্কিত। বর্তমানে বাঘ হত্যা কিংবা মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আরো বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ছে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
বাঘ বিশেষজ্ঞদের মতে প্রাণী জগতের মধ্যে বাঘ সবচেয়ে অরক্ষিত। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সুন্দরবনাঞ্চলে লবণাক্ততার মাত্রা ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়া ও খাদ্য সংকটের কারণে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের স্বাভাবিক জীবনচক্র পাল্টে যাচ্ছে। তাই রয়েল বেঙ্গল টাইগার আবাসস্থল সুন্দরবন ছেড়ে লোকালয়ে আসছে প্রায়ই।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ৫টি কারণে সুন্দরবনে হিংস্র বাঘ লোকালয়ে প্রবেশ করছে। কারণগুলো হচ্ছে -প্রথমত, বনে বাঘের প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাব। দ্বিতীয়ত, সুন্দরবনের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী ও খাল ভরাট হওয়ায় বাঘ সহজেই লোকালয়ে প্রবেশ করতে পারে। তৃতীয়ত, বয়োবৃদ্ধ বাঘ শিকারের ক্ষমতা হারিয়ে লোকালয়ে আসে। চতুর্থত, সুন্দরবনে লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং পঞ্চমত, অবৈধ শিকারিদের হামলায় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে লোকালয়ে ঢুকছে।
নানা কারণে প্রতি বছর গড়ে ৩টি করে বাঘ মারা যাচ্ছে। আর এভাবে বাঘ নিধন চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে রয়েল বেঙ্গল টাইগার সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। এ অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
তবে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের একটি সূত্রে পাওয়া গেছে ভিন্ন তথ্য। এ তথ্য মতে ১৯৬৩ সালে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ গাই মাউন্ট ফোর্ট ধারণা করেন সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১০০টি, ১৯৭৫ সালে বিশেষজ্ঞ হেনডিঙ ধারণা করেন সাড়ে ৩শ’ বাঘ থাকতে পারে, ১৯৮০ সালে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ পিটিনেস বলেন, ৪৬০টি বাঘের আবাসস্থল সুন্দরবন, ১৯৮২ সালে বন বিভাগের জরিপ অনুযায়ী ৪৫৩টি, ১৯৯৩ সালে তামাং নামক বিশেষজ্ঞের ধারণা ৩৬২টি বাঘ থাকতে পারে। গ্লোবাল টাইগার পপুলেশন ট্রেন্ড অনুযায়ী ১৯৯৩ সালে ৩শ থেকে ৪৭৯টি, জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিল ইউএনডিপি ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও-এর বিশেষজ্ঞদের মতে ৯৪ সালের শুমারি অনুযায়ী রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ৩৬৯টি। ১৯৯৬ সালে ৩শ থেকে ৪৬০টি, ১৯৯৮ সালের জরিপে ৩৬২টি বাঘ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। ২০০৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি- ৩ মার্চ পর্যন্ত বাঘশুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাচ্চাসহ রয়েল বেঙ্গলের সংখ্যা মিলেছে ৪৪০টি। সুন্দরবনের পানিতে ও মাটিতে নুনের ভাগ বেড়ে যাওয়ায় সুন্দরি গাছ কমে যাওয়ার পাশাপাশি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের স্বাভাবিক জীবনচক্র পাল্টে যাচ্ছে। বাড়ছে বাঘের মানুষ খাওয়ার প্রবণতা।
প্রাণিবিজ্ঞানীরা বলছেন, সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় বনের যে অংশের মাটিতে লবনের ভাগ কম, সে অংশে যেমন বাংলাদেশের দক্ষিণ দিকের সুন্দরবনে আশ্রয় নিচ্ছে বাঘ। আর সুন্দরবনের পশ্চিমবঙ্গের অংশে যে বাঘ রয়েছে তাদের মাংস খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত মানুষ আর কুকুরের মাংস মিষ্টি। সে কারণেই বাঘ মাঝে মাঝে লোকালয়ে আসছে। সুন্দরবনে বাঘের আচরণ নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তারা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যেভাবে সুন্দরবনে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বদলাচ্ছে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য রয়েল বেঙ্গল টাইগারের স্বভাব পাল্টাতে বাধ্য। যেগুলো তা পারেনি সেগুলো মারা পড়ছে নানা কারণে। সুন্দরবনের শরণখোলা চাঁদপাই খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জে কম-বেশি বাঘ হত্যা হয়। বাঘ হত্যার তালিকায় শীর্ষে রয়েছে চাঁদপাই রেঞ্জ।
সংশ্লিষ্ট বিভাগের দেয়া তথ্য অনুযায়ী বেশিরভাগ বাঘের মৃত্যু হয়েছে জনতার গণপিটুনিতে। বন বিভাগের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৮০ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৬৫টি বাঘ হত্যা করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী ও ট্যুরিজম বিভাগের ডিএফও’র ভাষ্য অনুযায়ী প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড়, বন্যায় এবং শিকারিদের হাতে বাঘ মারা পড়ছে। ক্ষুধার্ত বাঘ লোকালয়ে প্রবেশ করলে আত্মরক্ষার্থে জনগণ পিটিয়ে হত্যা করে।
বাঘ বিশেষজ্ঞদের মতে প্রাণী জগতের মধ্যে বাঘ সবচেয়ে অরক্ষিত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাঘ খাপ খেয়ে নিতে না পারায় এর সংখ্যা ক্রমেই কমছে। ২০১০ সালের পর বাঘ বিলুপ্তির সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবনে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।
সুন্দরবন বিভাগের সূত্র জানান, স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত নানা কারণে ১৪৫টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। প্রতি বছরই বাগেরহাটের শরণখোলা, মংলা এবং সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলায় বাঘ লোকালয়ে প্রবেশ করে। এ বাঘ প্রায় সময় কুকুর, ছাগল, গরু হত্যা করে। এ কারণেই ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষ গণপিটুনি দিয়ে বাঘ হত্যা করে।