ঢাকা ০১:১০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাসিমুখে মাশিয়াত

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। বাংলায় জিনতত্ত্ব প্রকৌশল। নাম দেখে খুব কঠিন, খটমটে, কাঠখোট্টা মনে হচ্ছে কি? এই বিষয়ে পড়েই কিন্তু মাশিয়াত নাওয়ার অর্জন করেছেন স্নাতক সনদ। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীর সিজিপিএ-৩.৯৯। চারে ৩.৯৯ পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা!
৫ নভেম্বর ছিল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দশম সমাবর্তন। ভালো ফলের পুরস্কারস্বরূপ অনুষ্ঠানে মাশিয়াতের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদক ও স্বর্ণপদক। পদকপ্রাপ্ত মেধাবী জিনতত্ত্ব প্রকৌশলীর সঙ্গে আলাপ করতেই ১০ নভেম্বর আমরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম প্রথম আলোর কার্যালয়ে।
বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ও লেভেল আর হার্ডকো ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে এ লেভেল শেষ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের প্রারম্ভেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন একদিন প্রাণীর জিন থেকে রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করবেন। জিনতত্ত্ব প্রকৌশল নিয়ে পড়ার আগ্রহের খানিকটা সম্ভবত মাশিয়াত জিনগতভাবেই পেয়েছেন। বাবা মো. হোসেন চৌধুরী ছিলেন ফার্মাসিস্ট। ‘ওষুধ আর রোগের প্রতিষেধক নিয়ে গবেষণাই যদি করতে চান, বাবার মতো ফার্মাসিস্ট হওয়ার কথা ভাবলেন না কেন?’ প্রশ্ন শুনে তাঁর জবাব, ‘ফার্মাসিতে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। রাসায়নিক ওষুধের দাম হয় চড়া। অন্যদিকে জিনতত্ত্বে যেমন গভীর গবেষণার সুযোগ আছে, তেমনি গবেষণার ফলে আবিষ্কৃত ওষুধ কিংবা প্রতিষেধকের দামও সুলভ। কারণ, প্রতিষেধকগুলো প্রাকৃতিক।’
দুই বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন। এরপর নানার বাড়িতেই তাঁর বেড়ে ওঠা। নানাভাইকে দেখেছেন পারকিনসন্স আর আলঝেইমার রোগে ভুগে জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে। সেই থেকে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আর কেউ যেন নানাভাইয়ের মতো কষ্ট না পায়, তিনি সেই চেষ্টাই করবেন। তাই গবেষণা করতে চান নিউরোলজিক্যাল ডিজিজ নিয়ে। মাশিয়াত জানালেন, দেশে এ বিষয়ে গবেষণা করার খুব ভালো সুযোগ নেই। তাই উচ্চশিক্ষা আর গবেষণার জন্য যেতে চান ইউরোপ বা আমেরিকায়। তবে ফিরবেনও শিগগিরই। স্বপ্ন পূরণের রসদ জুটিয়ে দেশে এসে কাজ করতে চান পুরোদমে।
ছোটবেলা থেকেই ঘরভর্তি বই আর বই দেখে পড়ার প্রতি খুব করে আগ্রহ জন্মেছিল মাশিয়াতের। তাই লেখাপড়াকে কখনোই খুব কষ্টকর কিছু মনে হয়নি। পড়তে তিনি ভালোই বাসেন। হোক সেটা পাঠ্যবই কিংবা ঝলমলে ম্যাগাজিন। বলছিলেন, ‘পৃথিবীতে অনেক কিছু জানার আছে। জানার আগ্রহ থেকেই পড়ি।’ সময়টা ইন্টারনেটের, খুঁজে খুঁজে কত কী অজানা বিষয় জানা যায়! মাশিয়াতও তা-ই করেন। নানা বিষয়ে এটা-ওটা পড়তে পড়তেই ঠিক করে ফেলেছিলেন, তিনি কী করতে চান। বিজ্ঞানের ছাত্রী বলে সব ভালোবাসা কেবল বিজ্ঞানের প্রতি, তা নয়। অর্থনীতিও তাঁর ভালো লাগার বিষয়। ক্লাস আর পরীক্ষার ব্যাপারে সব সময় ‘সিরিয়াস’ মাশিয়াত। পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, এটাই তাঁর ভালো ফলাফলের রহস্য।
আপাতত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন, মা খাদিজা আক্তার বনানী বিদ্যানিকেতনের শিক্ষক, মাশিয়াতের স্বপ্ন যাত্রার সহযোগী। আর পড়ালেখার আদর্শ মামাতো বোন আরশিয়া জেরনাব হাসান, যিনি বুয়েট থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে দেশের বাইরে পিএইচডি করছেন। সহপাঠী, পরিবার আর পড়াশোনাই যেন মাশিয়াতের সবকিছু। বইয়ে মুখ গুঁজে থাকা মেয়েটা কিন্তু ভালো গানও গাইতে জানেন। ছবি আঁকেন। ল্যান্ডস্কেপ আর কার্টুন আঁকতে ভালোবাসেন। ভালো ছাত্রী হিসেবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই তাঁকে চেনেন। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে দেশ, দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের মানুষ তাঁকে চিনবেন, সেই অপেক্ষায় আছেন!

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির ১৭ বছর পর বিজয় দিবস উদযাপন

হাসিমুখে মাশিয়াত

আপডেট সময় ০৫:০৬:২৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারী ২০১৬

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। বাংলায় জিনতত্ত্ব প্রকৌশল। নাম দেখে খুব কঠিন, খটমটে, কাঠখোট্টা মনে হচ্ছে কি? এই বিষয়ে পড়েই কিন্তু মাশিয়াত নাওয়ার অর্জন করেছেন স্নাতক সনদ। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীর সিজিপিএ-৩.৯৯। চারে ৩.৯৯ পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা!
৫ নভেম্বর ছিল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দশম সমাবর্তন। ভালো ফলের পুরস্কারস্বরূপ অনুষ্ঠানে মাশিয়াতের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদক ও স্বর্ণপদক। পদকপ্রাপ্ত মেধাবী জিনতত্ত্ব প্রকৌশলীর সঙ্গে আলাপ করতেই ১০ নভেম্বর আমরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম প্রথম আলোর কার্যালয়ে।
বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ও লেভেল আর হার্ডকো ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে এ লেভেল শেষ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের প্রারম্ভেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন একদিন প্রাণীর জিন থেকে রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করবেন। জিনতত্ত্ব প্রকৌশল নিয়ে পড়ার আগ্রহের খানিকটা সম্ভবত মাশিয়াত জিনগতভাবেই পেয়েছেন। বাবা মো. হোসেন চৌধুরী ছিলেন ফার্মাসিস্ট। ‘ওষুধ আর রোগের প্রতিষেধক নিয়ে গবেষণাই যদি করতে চান, বাবার মতো ফার্মাসিস্ট হওয়ার কথা ভাবলেন না কেন?’ প্রশ্ন শুনে তাঁর জবাব, ‘ফার্মাসিতে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। রাসায়নিক ওষুধের দাম হয় চড়া। অন্যদিকে জিনতত্ত্বে যেমন গভীর গবেষণার সুযোগ আছে, তেমনি গবেষণার ফলে আবিষ্কৃত ওষুধ কিংবা প্রতিষেধকের দামও সুলভ। কারণ, প্রতিষেধকগুলো প্রাকৃতিক।’
দুই বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন। এরপর নানার বাড়িতেই তাঁর বেড়ে ওঠা। নানাভাইকে দেখেছেন পারকিনসন্স আর আলঝেইমার রোগে ভুগে জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে। সেই থেকে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আর কেউ যেন নানাভাইয়ের মতো কষ্ট না পায়, তিনি সেই চেষ্টাই করবেন। তাই গবেষণা করতে চান নিউরোলজিক্যাল ডিজিজ নিয়ে। মাশিয়াত জানালেন, দেশে এ বিষয়ে গবেষণা করার খুব ভালো সুযোগ নেই। তাই উচ্চশিক্ষা আর গবেষণার জন্য যেতে চান ইউরোপ বা আমেরিকায়। তবে ফিরবেনও শিগগিরই। স্বপ্ন পূরণের রসদ জুটিয়ে দেশে এসে কাজ করতে চান পুরোদমে।
ছোটবেলা থেকেই ঘরভর্তি বই আর বই দেখে পড়ার প্রতি খুব করে আগ্রহ জন্মেছিল মাশিয়াতের। তাই লেখাপড়াকে কখনোই খুব কষ্টকর কিছু মনে হয়নি। পড়তে তিনি ভালোই বাসেন। হোক সেটা পাঠ্যবই কিংবা ঝলমলে ম্যাগাজিন। বলছিলেন, ‘পৃথিবীতে অনেক কিছু জানার আছে। জানার আগ্রহ থেকেই পড়ি।’ সময়টা ইন্টারনেটের, খুঁজে খুঁজে কত কী অজানা বিষয় জানা যায়! মাশিয়াতও তা-ই করেন। নানা বিষয়ে এটা-ওটা পড়তে পড়তেই ঠিক করে ফেলেছিলেন, তিনি কী করতে চান। বিজ্ঞানের ছাত্রী বলে সব ভালোবাসা কেবল বিজ্ঞানের প্রতি, তা নয়। অর্থনীতিও তাঁর ভালো লাগার বিষয়। ক্লাস আর পরীক্ষার ব্যাপারে সব সময় ‘সিরিয়াস’ মাশিয়াত। পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, এটাই তাঁর ভালো ফলাফলের রহস্য।
আপাতত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন, মা খাদিজা আক্তার বনানী বিদ্যানিকেতনের শিক্ষক, মাশিয়াতের স্বপ্ন যাত্রার সহযোগী। আর পড়ালেখার আদর্শ মামাতো বোন আরশিয়া জেরনাব হাসান, যিনি বুয়েট থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে দেশের বাইরে পিএইচডি করছেন। সহপাঠী, পরিবার আর পড়াশোনাই যেন মাশিয়াতের সবকিছু। বইয়ে মুখ গুঁজে থাকা মেয়েটা কিন্তু ভালো গানও গাইতে জানেন। ছবি আঁকেন। ল্যান্ডস্কেপ আর কার্টুন আঁকতে ভালোবাসেন। ভালো ছাত্রী হিসেবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই তাঁকে চেনেন। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে দেশ, দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের মানুষ তাঁকে চিনবেন, সেই অপেক্ষায় আছেন!